ইতি-নেতি-'ওরে তুই মন না রাঙিয়ে কেবল রাঙালি বসন' by মাসুদা ভাট্টি

এ কথা তো সত্য যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা একে একে সব কিছুই খুইয়ে ফেলছি। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একে একে ভেঙে পড়ার যে দৃশ্য আমরা বিগত সময়ে দেখেছি, তা ভয়াবহ। যেকোনো প্রতিষ্ঠান তা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয়, যাই-ই হোক না কেন,


তাতে ব্যক্তিমূল্যের চেয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য নিঃসন্দেহে বেশি। আমার মনে হয়, এখানেই আমাদের বোঝার ভুলটি রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পর্ক এবং ব্যক্তির কারণে প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
ব্রিটেন কিংবা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেই দেখা যায় একটি বিশেষ কামরায় মোটা ফ্রেমে বাঁধানো অনেক মানুষের ছবি। ছবির নিচে প্রত্যেকের নামের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য কী অবদান রেখেছেন, তা এক লাইনে হলেও লেখা থাকে। ষোড়শ শতক কিংবা তারও আগের মানুষের পোট্র্রেট দেখে, বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধাবনত হয় শির এবং আশ্চর্য লাগে এত দিন যাবৎ প্রতিষ্ঠানটি টিকে রয়েছে কিসের জোরে? আমরা বলতে পারি নোবেল পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের কথা। স্যার আলফ্রেড নোবেল, যাঁকে আজ আমরা শান্তিসহ নব নব আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখি সবচেয়ে বড় মাপের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সঙ্গে, আমরা ভুলতে পারি না যে তিনি মানুষ মারার অস্ত্র ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। সেদিক দিয়ে পৃথিবীতে মানুষ উদ্ভাবিত সবচেয়ে ভয়ংকর মারণাস্ত্র, অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্রও মানুষেরই বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে এই নেতিবাচক প্রক্রিয়া বন্ধ করা। টেলিভিশন যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি হয়তো ভাবেনওনি যে এ বাঙ্টি পৃথিবীর দেশে দেশে সংস্কৃতিকে এভাবে গ্রাস করবে। কিংবা ভিডিও যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি কি ভাবতে পেরেছিলেন, মানুষের বা পৃথিবীর দৃশ্য ধারণ করে রাখার চেয়েও পর্নোগ্রাফির জন্য তাঁর আবিষ্কার আরো বেশি জনপ্রিয় হবে? একেবারে আধুনিক আবিষ্কার ইন্টারনেট যখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয় তখন মানুষ ভেবেছিল যে অবাধ তথ্যপ্রবাহ পৃথিবীকে উত্তর-আধুনিকতার মর্যাদা দেবে। অথচ আজ ইন্টারনেট তার মর্যাদায় কালি মেখেছে শিশুদের দিয়ে বিকৃত মানুষের যৌনতৃষ্ণা মেটানো বা পর্নোগ্রাফির সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে। বাংলাদেশে যখন মোবাইল কম্পানি যাত্রা শুরু করে তখন আমরা দেখেছি, দেশে দেশে প্রচারিত হয়েছে তার মহিমা, কী করে মোবাইল ফোন গ্রামের নারীর ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও কি দারিদ্র্য নেই? কিন্তু সেসব দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষকে কেউ ঠিক এভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে বলে নজির নেই। আজ সেই মোবাইল ফোন হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের, সন্ত্রাসের, নারীকে অপমানের অন্যতম বড় অস্ত্র।
এসব আবিষ্কার বা প্রতিষ্ঠানের ভালো কোনো দিক নেই তা নয়। এখানে বলার কথা এটাই যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মাত্রেরই কাজ বা আবিষ্কার সব সময় জনগণের পক্ষে কাজ করবে তা নয়। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এ দেশে অনেক কথা শোনা যায়। বলা হয়, এ দেশেই এর প্রথম প্রচলন। কিন্তু একসময় এসে দেখা গেল, পশ্চিমে যে ক্রেডিট কার্ড প্রথা প্রচলিত, ক্ষুদ্রঋণ আসলে তারই ম্যাক্রো বা ক্ষুদ্র ভার্সন। ব্রিটেনের কথা বলি। বাঙালি কিংবা অন্য দেশ থেকে যাঁরাই থাকার জন্য ব্রিটেনে যান তাঁদের প্রথমেই একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কিছুদিন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের পর ব্যাংকগুলো থেকে চিঠি আসতে শুরু করে। সেসব চিঠির ভাষ্য মোতাবেক অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি নূ্যনতম ১০ হাজার পাউন্ড ধার কিংবা ক্রেডিট কার্ডে খরচ করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ থাকে। একজন বাঙালি প্রথমেই হিসাব কষেন, ১০ হাজার পাউন্ড মানে ১০ লাখ টাকা। বিষয়টি তখন আর স্বাভাবিক থাকে না, অস্বাভাবিক এ লেনদেনের ফাপরে পড়ে মানুষটি যে ভুলটি করে তা হলো ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করে এবং তা দিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক খরচ করতে শুরু করে। তার হুঁশ থাকে না যে একসময় তাকে টাকাটা ফেরত দিতে হবে এবং আসলে ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার অন্য যেকোনো লোনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। আমার জানা এ রকম সর্বস্বান্তের (ব্যাংকক্র্যাফট) সংখ্যা বিশাল। পরবর্তী জীবনে তারা না পারে অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে, না পারে মর্টগেজ কিংবা অন্য বড় কোনো লোন নিয়ে জীবন ধারণ করতে, যদি না তারা বড় মাপের কোনো চাকরি পেয়ে আগে করা খরচ সুদসমেত ব্যাংকে ফিরিয়ে দেয়। যদিও এই যে কিছুদিন আগেও ব্রিটেন পৃথিবীর মন্দাকবলিত দেশগুলোর প্রায় শীর্ষতম অবস্থানে ছিল তার মূলের কয়েকটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল ক্রেডিট কার্ড, মানুষ খরচ করেছে দেদার, কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়ার কথা কেউ মনে রাখেনি। এখন অবশ্য সে দৃশ্যের বদল ঘটেছে, এখন চাইলেই কেউ ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারবে না, চাইলেই যেকোনো লোনও পাবে না। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, ব্রিটেনসহ ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালি ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে এ ঋণগ্রহণ ও ঋণগ্রহণ করে দেউলিয়ার সংখ্যা অন্য অভিবাসী সমাজের তুলনায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পও এ ক্রেডিট সিস্টেমের বাইরে কিছু নয়। মানুষ ঋণ নিয়ে বিশাল কিছু করবে, তাও আবার এত বড় সুদের অঙ্ক মিটিয়ে দিয়ে এই তত্ত্ব যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে উল্লেখ করা হোক না কেন, তা আসলে যারা লোন নিয়েছে তাদের জীবনধারণ থেকেই বোঝা যায়। আমার গ্রামের কথা বলতে পারি, প্রায় প্রতিটি পরিবারই এ ক্ষুদ্রঋণের আওতায় আছে। ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যারা ঋণ নিয়েছে তারা তুলনামূলক ভালো আছে। কেন? ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণও একটি ক্রেডিট কার্ড কিন্তু ব্র্যাক এ কার্ডের সঙ্গে যা দিচ্ছে, তাতে যুক্ত আছে স্বাস্থ্যকার্ড, শিক্ষাকার্ড, এমনকি মৌলিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থাও। এখানেই অন্য কারোর ক্ষুদ্রঋণের ত্রুটি।
ক্ষুদ্রঋণকে অসার প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি বলতে চাইছি, যেকোনো ব্যক্তির উদ্ভাবনেরই নানা রকম ত্রুটি থাকে এবং কালের সঙ্গে সেসব ত্রুটি দূর করার মাধ্যমে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটিকে সফল করেন এবং ব্যক্তি চলে গেলেও প্রতিষ্ঠান যাতে টিকে থাকে তার পথ পরিষ্কার রাখেন। ক্ষুদ্রঋণের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠান হিসেবেই এটিকে টিকে থাকতে হবে, ব্যক্তিনির্ভর হয়ে নয়, একটি সফল সিস্টেম হিসেবে_এটাই মোদ্দা কথা। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আজকের প্রযুক্তিজগতে যাঁরা দাপিয়ে-কাঁপিয়ে রাজ করছেন, সেই গুগল ও অ্যাপল, প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার খুঁজছে। তারা বলতে চাইছে, যে ভিশন বা দূরদৃষ্টি নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান দুটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঠিক সে রকম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষই কেবল পারবে এদের চালিয়ে নিতে ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনাগত আগামীতে টিকিয়ে রাখতে। খুব স্বাভাবিক, যদি কোনো অদূরদর্শী, খ্যাপাটে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কারো হাতে এর দায়িত্ব পড়ে তাহলে এ প্রতিষ্ঠান দুটিকে টিকিয়ে রাখা যে কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্রঋণদাতাদের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
পদাবলী কীর্ত্তনের একটি লাইন দিয়ে আজকের মতো শেষ করি_'ওরে তুই মন না রাঙিয়ে কেবল রাঙালি বসন'। মানুষের মনের ক্ষুদ্রতা না সরিয়ে কেবল গেরুয়া বসন পরে নিজেকে সাধু সাজানোর প্রচেষ্টার নিন্দা করা হয়েছে এখানে। ভেবে খুব আশ্চর্য লাগে যে ক্ষুদ্রঋণের মূলমন্ত্র হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রাথমিকভাবে যাঁরা যা বলেন তা হলো, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের কথা। কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে?
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.