বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ-সমস্যা মরগাঙের মানুষখেকো বাঘ by খসরু চৌধুরী

কিছু কিছু বাঘের মানুষেখেকো হয়ে ওঠা সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের অন্যতম প্রতিবন্ধক। কারণ, বাঘের জঙ্গলের কাছাকাছি যারা থাকে, সেসব অঞ্চলের জনসাধারণ, বনচারী মানুষ বাঘের হাতে মারা পড়ে বাঘের ওপর ভয়ংকর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পরিবারের একজন সক্রিয় সদস্য যদি বাঘের শিকার হয়ে পড়েন, তাতে পরিবারটিও ভেঙে পড়ে।


লোকালয় থেকে দূরে গভীর জঙ্গলে বাঘ মানুষ মারলে মানুষ সেসব জঙ্গল এড়িয়ে চললে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারে। দূরবর্তী বনে মানুষখেকো বাঘের অত্যাচার বনপ্রান্তবর্তী বাসিন্দাদের অনেকটা গা-সহা। কিন্তু লোকালয়ঘেঁষা বনে যদি মানুষখেকোর প্রাদুর্ভাব হয় আর সে বাঘ যদি খাল পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রামে ঢুকে ছাগল, কুকুর টেনে নিয়ে যায় তাহলে গ্রামবাসীর দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ভুক্তভোগী জনতার কাছে বাঘ সংরক্ষণের কথা বলতে গেলে ঠ্যাঙানি খাবার সমূহ আশঙ্কা আছে।
গত ১৩ মে ২০১০ থেকে এমনই একটি মানুষ মারা বাঘের উপদ্রব শুরু হয়েছে পশ্চিম সুন্দরবনের গ্রাম লাগোয়া ৪৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টে। কদমতলা স্টেশন অফিস, চুনকুড়ি টহল ফাঁড়ি, মরগাঙ টহল ফাঁড়ি, ট্যাংরাখালি টহল ফাঁড়ি ও কৈখালী স্টেশন অফিস এলাকার লোকালয়সংলগ্ন বনে মানুষ মেরে বাঘটি বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছে। এ দিকটায় উত্তরে লোকালয়, দক্ষিণে বন, মাঝে ছোটখাল বা নদী দিয়ে সীমান্ত রেখা টানা। খাবারের জন্য মাছ ধরতে, জীবিকার জন্য কাঁকড়া ধরতে, জ্বালানির জন্য শুকনো গাছের ডালপালা সংগ্রহ করতে আশপাশের গ্রামবাসীরা মেয়ে-পুরুষনির্বিশেষ অনাদিকাল থেকে দক্ষিণপাড়ের বাদার ওপর নির্ভরশীল। তার ওপর এখানকার খাল, ভারানীগুলোতে ১৯৮৫ সালের পর থেকে মীন (চিংড়িপোনা) ধরতে মেয়েরাই বেশি জলের ধারে ঘোরাফেরা করে। গত বছর ‘আইলা’ জলোচ্ছ্বাসের পর এলাকার চিংড়ির ঘের নষ্ট হওয়ায় ঘের এলাকায় তেমন কাজের সুযোগ নেই। ফলে বনপ্রান্তবর্তী লোকালয়ের মানুষ জঙ্গলের উপজাতের ওপর বেশি নির্ভর হয়ে পড়ছে।
তাদেরই ওপর হামলে পড়ছে এ বাঘটি। গত ১৩ মে বাঘটি সকাল ৯ টা ৪০ মিনিটে তুষখালী খালপাড়ের জঙ্গলে রাহুল মোড়ল (২০) ও রুবেল মোড়লকে (১৫) গুরুতর আহত করলে আশপাশের সঙ্গীরা তাদের ছাড়াতে সক্ষম হয়। পরদিন সকাল ১১টার দিকে কাঁকড়াশিকারি সাবিরউদ্দিনকে (৫২) বড়কেয়াখালী খালপাড় থেকে তুলে জঙ্গলে টেনে নিয়ে মেরে ফেলে। সঙ্গীরা আধখাওয়া লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনার পরদিন ১৫ মে দুপুর একটায় চুনা নদীর তীরে মুজিবুর রহমানকে (৩৫) বাঘে ধরলে সঙ্গীরা তাঁকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে। তিনিও গুরুতর আহত হয়। পরদিনই দুপুর একটায় কোনাবাগদী ভারানীতে মীনধরা নাসিমা বেগমকে (২৬) খালপাড় থেকে বাঘে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। কিছুটা অংশ খাবার সময় গ্রামবাসী লাশ উদ্ধার করে। পরদিন ১৭ মে দুপুর দুইটায় গোলাম মীরের খাল থেকে হরিপদ মণ্ডলকে বাঘ জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। হরিপদর সামান্য অংশই বাঘের পেটে গেছে। কারণ, গ্রামবাসী লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এরপর গ্রামবাসী জঙ্গলের দিকে খালপাড়ে যাওয়া বন্ধ করলে গত ১৯ মে বাঘটিকে বিকেলের দিকে জঙ্গলের ধারে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এরপর গত ২১ মে দিবাগত রাতে বাঘটি খাল পাড় হয়ে গ্রামে ঢুকে তিনটি ছাগল মারে এবং একটি কুকুর মেরে জঙ্গলে ফিরে যায়। এর পরের অবস্থা জানতে পারিনি।
আমার সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘের পিছু লাগার অভিজ্ঞতায় এ বাঘটির আচরণ মেলাতে পারছি না। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চাঁদপাই এলাকার এক বাঘ লোকালয়ের ধারের জঙ্গলে মানুষ ধরত। বাঘটি গরুমারা বাঘ ছিল। হাতায় গুলি খেয়ে মানুষখেকো হয়। মানুষখেকো হওয়ার পর কোনো দিন গ্রামে ঢোকেনি। সেই পুরুষ বাঘটিও কখনো পরপর এত মানুষ ধরেনি। তা ছাড়া তিন-চারটা কম্পার্টমেন্টে সে কয়েক দিনের বিরতিতে মানুষ মারত। সেই বাঘটা নিশ্চিত হত্যাকারী ছিল, কাউকে আহত করে ছেড়ে দিত না। ষাটের দশকে দুবলা এলাকায় একটি বাঘিনী নিউজপ্রিন্ট মিলের বাওয়ালিদের ওপর প্রায় প্রতিদিন হামলা চালিয়ে অনেককে আহত করেছিল। শিকারি জিয়াউল হক বাঘটি গুলি করে মারার পর দেখতে পান বাঘিনীর ওপরের দুটো শ্বাদাঁতই ভাঙা। স্বাভাবিক শিকার কামড়ে রাখার ক্ষমতা তার ছিল না।
বৈখালী-কদমতলী এলাকার বাঘটিও (পায়ের ছাপ দেখে বনবিভাগ পুরুষ বাঘ শনাক্ত করেছে) সম্ভবত কোনো কারণে শ্বাদাঁত হারিয়েছে। এটি বয়সী বাঘ। পাইওরিয়ায় অনেক সময় বাঘের দাঁত নষ্ট হয়। আবার স্বাভাবিক শিকারের সময় ধ্বস্তাধ্বস্তিতেও অনেক সময় দাঁত ভেঙে যেতে পারে। আবার শূকরের দাঁতের আঘাতে বাঘের চোয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ যা-ই হোক এটা নিশ্চিত. বাঘটির স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা নেই। মানুষের মতো দুর্বল শিকারই তার ভরসা।
এ অবস্থায় এ বাঘটির ভাগ্য চারভাবে নির্ধারণ হতে পারে। গ্রামে ঢুকে যেহেতু বাঘটি কুকুর-ছাগল মারছে তাতে গ্রামবাসী এটিকে গ্রামে মেরে ফেলতে পারে। দ্বিতীয়ত, এটিকে বন বিভাগ ট্রাংকুলাইজ (ঘুম পাড়ানো বন্দুকের সহায়তায় অচেতন করে) করে দক্ষিণে গভীর বনে ছেড়ে দেয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুবার গ্রামে ঢোকা বাঘ ট্রাংকুলাইজ করে গভীর বনে ছেড়ে দেখা গেছে দুবারই বাঘ দুটি স্থানিক বাঘের আক্রমণে মারা গেছে। এখানকার বাঘটির ভাগ্যেও সেটাই ঘটবে সম্ভবত। তৃতীয়টি হলো, প্রাণীটিকে প্রধান বন সংরক্ষক কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা।
বাঘটির একমাত্র বাঁচার উপায় ট্রাংকুলাইজ করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে সাফারি পার্কে স্থানান্তর করা।
এ ব্যাপারে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী শাখার বন সংরক্ষক তপন কুমার দের সঙ্গে সেলফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাঘটি বাঁচাতে চাচ্ছি। ট্রাংকুলাইজ করার চেষ্টা করছি। আপাতত আমাদের এনক্লোজারে রাখব, চিকিৎসার প্রয়োজনে চিকিৎসা করব।’
উদ্যোগটি আশাপ্রদ। দেশের কোনো চিড়িয়াখানায় সুন্দরবনের বাঘ নেই। এই বাঘটি জ্যান্ত অবস্থায় ধরা পড়লে দেশবাসীর সুন্দরবনের তথা জাতীয় পশু দেখার সুযোগ মিলবে।
খসরু চৌধুরী: সুন্দরবন ও বাঘ বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.