ধর নির্ভয় গান-বড় সহজ নয়, যা চাই তা পাওয়া by আলী যাকের

যে মানুষরা, বিশেষ করে যে তরুণরা, প্রগতিশীলতার পক্ষে গত নির্বাচনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে, সেই তরুণদেরই রাজপথে নেমে আসতে হবে তাদের দাবিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে, যাতে সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব প্রগতিশীল সিদ্ধান্ত নির্বিঘ্নে নিতে পারে। কেবল দোষারোপে কাজ হয় না।
কাজ করার ইচ্ছাটা উদাহরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। আজ এখনই সেই সময় উপস্থিত। নয়তো ভবিষ্যতে কোনোকালেই এসব দাবি পূরণ করা সম্ভব হবে না


আমি সাধারণত এই কলামটি হালকা মেজাজে, দুলকি চালে লিখি। সহজ সাবলীল হয় আমার লেখার গতি এবং এর মধ্য দিয়ে আমি প্রায়ই তুলে ধরি এমন সব বিষয়, যা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পরিবেশ, প্রকৃতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইত্যাকার বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী হয়ে আজকের বিশ্বে কোনো জাতি সামনের দিকে এগোতে পারেনি। অনেকেই মনে করে, এসব আমাদের জীবনের মৌল বিষয় নয়, অনুষঙ্গ মাত্র। কিন্তু একটি জাতির জীবনে উলি্লখিত বিষয়গুলোই মৌল বিষয় হিসেবে ধরে নিলে তার রাজনীতি এবং অর্থনীতির সঠিক পথে চলার একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। যেহেতু জাতি হিসেবে আমরা এখনও সম্পূর্ণ শিক্ষিত হতে পারিনি, অথবা বলা যায় শিক্ষিত হিসেবেই আমাদের স্বাধীন সত্তার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং পরে আমাদের শাসকদের অর্বাচীনতায় আমরা অশিক্ষার পথে ধাবিত হয়েছি, সেহেতু এ ধরনের অনেক ভ্রান্ত ধারণা আমাদের অধিকার করে নিয়েছে।
এই যে অসম্পূর্ণ শিক্ষা, এ বিষয়টি আমাদের অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবেও তুলে ধরে বিশ্ব সমাজে। এই চিন্তার অসম্পূর্ণতার অনেক নিদর্শন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মধ্যে কেউ যদি এ ধরনের রব তুলে দেয় যে, কারও কান কাকে নিয়ে গেছে, তবে আমরা নিজের কানে হাত দিয়ে তা পরীক্ষা না করে কাকের পেছনে দৌড়াই। এর কারণ হচ্ছে এই যে, আমরা কানকথায় বড্ড বেশি বিশ্বাস করি। অনেক গুজব, যার ভিত্তি নেই, তা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পাঠক প্রশ্ন করে দেখবেন যে, কেউ ওই গুজবের উৎস সম্বন্ধে সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু তার সত্যতা সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। একবার এ রকম একটি গুজবের উৎসের সন্ধানে আমি পেছনে যেতে যেতে একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে পেঁৗছেছিলাম। সেখানে প্রশ্ন করাতে জবাবটা পেলাম অনেকটা এ রকম, 'ওই যে কে যেন বলল? কার কাছে যেন শুনলাম? কোথায় যেন? কখন যেন?' ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক ব্যাপারেও আমরা, বিশেষ করে আমাদের তরুণতর জনগোষ্ঠী, বড় উত্তেজিত হয়ে, পূর্বাপর সম্বন্ধ না রেখে, এমনসব কথা বলে ফেলে যার ধারাবাহিকতায় কেবল অনুযোগ, অভিযোগ এবং মুখের কথা ছাড়া আর কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি আমাদের অভিযোগগুলোও যাদের উদ্দেশ্যে, যে কারণে এবং যতখানি তীব্রতার সঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত, তা হয় না। প্রসঙ্গত আমাদের বিগত সাধারণ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করতে হয়। আমরা একটি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে ওই নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, যে আদর্শ ও মূল্যবোধ নিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে ৪০ বছর আগে এবং যে আদর্শ ও মূল্যবোধ ক্রমেই ধ্বংস হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর '৭৫-পরবর্তী কিছু পাকিস্তানপন্থি রাজনীতিবিদের দুঃশাসনের ফলে, সেই আদর্শকে পুনর্বাসিত করা। যারা ওই নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন, তারাও আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে আমরা আবার ফিরে পাব।
আজ উলি্লখিত নির্বাচনের আড়াই বছর পরে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সেই মহান উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। যারা প্রায় আপসহীন হয়ে আমাদের আদর্শ সম্বন্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভই কেবল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সব উদ্দেশ্য হাসিল করতে সক্ষম হবে, তারা দেখতে পাচ্ছেন, বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম তিন বছর এবং মাঝখানে বছর পাঁচেকের একটা যতি_ এই আট বছরের ইতিহাস আমাদের দীর্ঘ চলি্লশ বছরের ইতিহাসের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। ওই সময় গুছিয়ে বসে আমাদের আদর্শ এবং মূল্যবোধ শাসিত কোনো নীতি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমি অনেক জায়গায়, বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও পাকিস্তানের তল্পিবাহক কিংবা পাকিস্তানি মনমানসিকতার ধারক কিছু মানুষ এদেশে বসেই বাংলাদেশের চেতনাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। যেহেতু এ দেশের নামটি বদলানো সম্ভব নয় সেহেতু এই নামেই দ্বিতীয় আরেকটি পাকিস্তানের জন্ম দেওয়া যায় কি-না সে চেষ্টাও এই ষড়যন্ত্রের অন্তর্গত। কথিত আছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ ধরনের কিছু কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে ভারতের প্রবীণ এবং প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ জগজীবন রাম তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, 'ওহে কন্যা আমার, তুমি একটি পাকিস্তান ভেঙেছ বটে, কিন্তু দুটি পাকিস্তান বানিয়েছ।' এই যে পাকিস্তানি মনমানসিকতা, এতে ইন্ধন জোগানোর জন্য এই উপমহাদেশের বাইরে যেমন একাধিক পরাশক্তি সক্রিয় ছিল দীর্ঘ সময় ধরে, তেমনি পাকিস্তানের নানা গোয়েন্দা সংস্থাও এই পাকিস্তানিমনাদের ক্রমাগত এই দুষ্কর্মে সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছে। এভাবেই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অনুমোদিত হয়েছিল ধর্মান্ধতাভিত্তিক রাজনীতি এবং চাপা পড়ে গিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন। এসবই প্রকৃতপক্ষে একই সূত্রে গাঁথা। লোকমুখে শুনতে পাই, পাকিস্তানপন্থি কিছু বাংলাদেশি সরকারের আমলে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য আমাদের পার্বত্যাঞ্চল ছিল একটি অভয়াশ্রম। তারা সেখান থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ক্রমাগত অস্থিরতা বজায় রাখার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নাকি করত।
বিগত নির্বাচনে আমাদের অনেক তরুণ ভোটার প্রথমবারের মতো তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। এরা বাংলাদেশের জন্মের সঠিক ইতিহাসটি সম্বন্ধে কেবল যে অবহিত ছিল তা-ই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির আত্মদান সম্বন্ধেও সচেতন ছিল। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পুনর্বাসন_ এ দুই এজেন্ডা তাদের ভোট প্রদানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। আজ 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের' এই সরকারের শাসনের অর্ধেক সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর স্বভাবতই এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এক. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হলো? এবং দুই. ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত যে সংবিধান, লাখো নারীর সম্ভ্রম পুনর্বাসনের যে সংবিধান, সেই সংবিধানকে যে বিভিন্নভাবে অপবিত্র করা হয়েছে তার সংশোধনের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো? আমরা দেখতে পাই, এ সম্বন্ধে এখনও কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের এই অক্ষমতায় সরকারকে নির্বিচারে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করে আমি আজকের চিন্তাশীল মানুষদের, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে একটু ভাবতে বলব যে, কোনো কারণে আজকের সরকারের হাত-পা কি বাঁধা? যে কারণে এ ধরনের প্রগতিশীল অথচ বলিষ্ঠ পদক্ষেপগুলো তারা নিদ্বর্িধায় নিতে পারছেন না? আমরা যদি একটু চিন্তাশীল এবং অনুসন্ধিৎসু হই, তাহলেই দেখতে পাব যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন কিংবা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করলেই ধর্মের পরাকাষ্ঠা হওয়া যায় না। এই পদক্ষেপগুলো স্বৈরাচারী ফরমানের দ্বারা সংবিধানে সংযোজনের পরও অবলীলায় অধর্মের কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা যায়, দুর্নীতিতে দেশকে ছেয়ে ফেলা যায়, ব্যভিচারী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া যায় এবং যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু ওই বিসমিল্লাহ্ এবং রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে একবার সংযোজিত হলে এবং যুদ্ধাপরাধীদের গুরুতর অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখলে সেগুলো খুব সহজে আবার পরিবর্তন করা যায় না। মানুষ অভ্যাসের দাস। কোনো কথা দীর্ঘদিন ধরে শুনতে থাকলে মানুষ সে কথায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে। তখন তার সেই বিশ্বাসকে, তা যত যুক্তিহীনই হোক না কেন, টলানো খুব সহজ নয়। একে সম্ভব করতে হলে কেবল রাজনীতিবিদদের একক প্রচেষ্টায় তা সম্ভব নয়। যারা সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতার কারণে যুদ্ধাপরাধ করেছিল তাদের শাস্তি দিতে হলে এই সমাজ থেকে মৌলবাদের জড় উপড়ে ফেলে দিতে হবে সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দ্বারা।
অতএব যে মানুষরা, বিশেষ করে যে তরুণরা, প্রগতিশীলতার পক্ষে গত নির্বাচনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে, সেই তরুণদেরই রাজপথে নেমে আসতে হবে তাদের দাবিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে, যাতে সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব প্রগতিশীল সিদ্ধান্ত নির্বিঘ্নে নিতে পারে। কেবল দোষারোপে কাজ হয় না। কাজ করার ইচ্ছাটা উদাহরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। আজ এখনই সেই সময় উপস্থিত। নয়তো ভবিষ্যতে কোনোকালেই এসব দাবি পূরণ করা সম্ভব হবে না।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.