মানুষের মুখ-যুদ্ধ করেছি কণ্ঠ দিয়ে by মৃত্যুঞ্জয় রায়

‘সীমান্তে টাকি নদীর পারে যখন পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যে। সেখানে পৌঁছে দেখি, ভারত থেকে কিছু লোক নৌকা নিয়ে এ দেশ থেকে শরণার্থীদের পার করে ভারতে নিয়ে যাচ্ছে, জনপ্রতি এক টাকা। দেশ ত্যাগের সময় কিছুই সঙ্গে আনতে পারিনি, প্রাণটা ছাড়া। সঙ্গে পরিবারপরিজন। ওদের রক্ষা করাই তখন আমার কর্তব্য।


আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। সবাইকে নিয়ে টাকি নদী পার হয়ে টাকি-হাসনাবাদের এক বাঁশতলায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। রাতে সে বাঁশতলাতেই শয্যা পাতলাম। কয়েক দিনের ভ্রমণ ক্লান্তি আর প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু চিন্তার আশঙ্কা থেকে কিছুটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাঁশতলায় সেই ধুলোমাটির মা যেন পরম মমতায় আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ঘুমানোর মুহূর্ত পর্যন্ত চোখ মেলে শুধু দেখতে লাগলাম শরণার্থীদের দীর্ঘ মিছিল, ভারতের মাটিতে একটু নিরাপদ আশ্রয়।
রাত আনুমানিক ১টা বা ২টার দিকে গোলাগুলির শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। নদীর ও-পারে খুব গোলাগুলি হচ্ছে। অনুমান করলাম, হতভাগ্য শরণার্থীদের কপালে কী ঘটছে। ভোরে সংবাদ পেলাম, গত সন্ধ্যেয় যেসব লোক আমাদের সঙ্গে পার হতে পারেনি, তারা ভোরে পারের অপেক্ষায় ওপারে ছিল। তাদের ওপর গোলাগুলি হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের টাকা-পয়সা সোনা-দানা তো লুটে নিয়েছেই, কেড়ে রেখে দিয়েছে যুবতী মেয়ে ও বউ-ঝিদের। যারা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। ভোরে নদী পার হয়ে আসা কিছু লোকের মুখে ওই ঘটনার কথা শুনে বেদনায়-দুঃখে মনটা ভীষণভাবে মোচড় দিয়ে উঠল। হায় রে হতভাগারা! দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া ওদের জন্য যেন আর কিছুই করার রইল না। ভাবলাম, এভাবে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে মরার চেয়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করে মরাই তো ভালো ছিল। মনের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভে মনটা ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে উঠল। পরিবারে আমিই একমাত্র পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষ। তাই পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতে পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, অস্ত্র দিয়ে নয়, আমি শিল্পী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ করব আমার কণ্ঠ দিয়ে।
যাহোক সকালবেলা আমি আমার পরিবারসহ টাকি জমিদার বাড়ির বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেখানে অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটে গেল চার-পাঁচটা দিন। কোথায় যাব, কী করব? একদিন দেখলাম, লোক নিয়ে কয়েকটা বাস বারাসাত আসা-যাওয়া করছে। কিছুই চিনি না। সবার সঙ্গে তাই আমরাও উঠে পড়লাম সে বাসে। বারাসাত গিয়ে পৌঁছালাম বটে, কিন্তু কোথায় থাকব, কী খাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। অবশেষে বারাসাত কোর্ট ময়দানে পড়ে থাকা একটা পরিত্যক্ত ভাঙা বাসের ভেতর আশ্রয় নিলাম, সেখানেই আপাতত আমাদের থাকার জায়গা হলো।
আমি বাংলা ছাড়া কথা বলতে পারি না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য কোথাও যাব না। তাই বারাসাতে থেকেই খুঁজতে লাগলাম কাজ, আশ্রয় আর স্বাধীন বাংলা বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপ সারাক্ষণ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তাই এমন কিছু গান গাইতে চাইলাম যে গান শুনে মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকার কথা মানুষ জানতে পারে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ করতে সাহস জোগায়। তাই আমার কলম ও কণ্ঠ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাঙা বাসের ভেতরে বসেই গান লেখা শুরু করলাম—মুক্তিযুদ্ধের গান। আমি দেশের যে চিত্র দেখে এসেছি, গানের মধ্যে সে কথাগুলোকেই ফুটিয়ে তুললাম। তবে গান লিখলেই তো হবে না। সেগুলোর কথা মানুষকে জানাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতে হবে। সেসব গান জনগণের সামনে গাইতে হবে। কিন্তু কী করে গাইব, কে আমাকে সে সুযোগ করে দেবে? ভাবলাম, এ জগতে কেউ কাউকে সুযোগ দেয় না—যার সুযোগ তাকেই করে নিতে হয়।
গানটায় সুর করার পর তা গাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম। তাই একদিন বেরিয়ে পড়লাম। বারাসাত কোর্ট ময়দানে দেখি এক ক্যানভাসার গান গাইছে। তাকে ঘিরে গোল হয়ে অনেক লোক গান শুনছে। আমি চট করে তার হাত থেকে হারমোনিয়ামটা কেড়ে নিয়ে দরাজ গলায় গান ধরলাম—“ধন ছিল, জন ছিল সবই ছিল ভাই/ আজ যে মোরা সর্বহারা, মোদের কিছু নাই।” গানটির মধ্যে ছিল তখনকার পাকিস্তানের অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণের করুণ কাহিনি। হঠাৎ ভিড় ঠেলে কে একজন আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বাদশা না সাহেব কি যেন নাম বললেন, মনে নেই। জিজ্ঞাসা করলেন আমি এ গানটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাইতে পারি কি না। আমি তো এই সুযোগই চাইছিলাম। হঠাৎ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। মুহূর্তেই রাজি হয়ে তার সঙ্গে ছুটলাম কলকাতায়। কলকাতায় পার্কসার্কাসে এক বাসার দরোজা ফাঁক করে ঢুকতেই পরিচিত মানুষদের দেখে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, মো. আবদুল জব্বার, মান্না হক, মলয় ঘোষ দস্তিদার, গোবিন্দ হালদার প্রমুখ বসে আছেন। সবাই শুনলেন আমার গানটা। আশফাকুর রহমান খান সাহেব নিজেই গানটি রেকর্ড করলেন। এরপর থেকে একের পর এক লিখে যেতে লাগলাম মুক্তিযুদ্ধের গান আর তা গাইতে লাগলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।’
খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার চুনকুড়ি নদীর পারে সাহেবরারবাদ গ্রামে বসে ৯০ পার হওয়া শিল্পী মনোরঞ্জন সরকারের বাড়ি বসে এসব স্মৃতিচারণার কথা শুনছিলাম তন্ময় হয়ে। শোনার পর আর নিজের কিছু লেখার ইচ্ছে রইল না। তাই তার বয়ানটাই তুলে দিলাম।

No comments

Powered by Blogger.