প্রত্নস্থলে মাৎস্যন্যায় by এ কে এম শাহনাওয়াজ

আমরা যারা বাংলাদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জানার চেষ্টা করি, গবেষণার চেষ্টা করি_তারা একটি বিষয়ে দারুণভাবে বিস্মিত আর হতাশ হই। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কাছেও এ দেশের ঐতিহ্যিক গৌরবের গভীরতা স্পষ্ট নয়।


পাঁচ শতকের পর ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক জীবনে গ্রামীণ জীবনব্যবস্থায় যখন মানুষ বন্দি, তার বহু আগে অর্থাৎ আট থেকে ছয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলে দ্বিতীয় নগরায়ণ শুরু হয়ে গেছে। এ পর্বে চার থেকে তিন শতকে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে বাংলাদেশে। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থল সে গৌরব বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপে ৯ থেকে ১০ শতকে একটু একটু করে শিক্ষার আলো জ্বলে গির্জাগুলোতে। পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে এগারো থেকে বারো শতক লেগে যায়। অপরদিকে বাংলায় আট শতকের মধ্যেই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। আমাদের পূর্বপুরুষের এই উজ্জ্বল কৃতিত্ব জেনে নতুন করে বর্তমান প্রজন্মকে আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য তাদের নিয়ে যেতে হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার প্রত্নগুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে। যেমন_অন্যতম প্রাচীন নগর মহাস্থানগড়ে গিয়ে তারা নিঃসন্দেহ হবে আজকের আধুনিক সভ্যতায় বাস করা দাম্ভিক দেশগুলোর অন্ধকারাচ্ছন্ন দশা, যখন সে যুগে বাংলায় গড়ে উঠেছিল নগর সভ্যতা। নওগাঁর পাহাড়পুর বিহার, ময়নামতীর শালবন বিহার, আনন্দ বিহার এসব স্পষ্ট করবে ইউরোপ নয়_বাংলা-বিহার অঞ্চলই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিল পৃথিবীতে। এভাবে ঐতিহ্য প্রজন্মের মধ্যে বারবার মানসিক শক্তি ফিরিয়ে দেয়। একটি দেশ ও একটি জাতিকে নতুনভাবে প্রত্যয়ী হয়ে এগিয়ে যেতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাই চালিকাশক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এসব কারণে সভ্য দেশগুলো অনেক যত্নে নিজ দেশের প্রত্ন-ঐতিহ্য রক্ষা করে। অক্ষরে অক্ষরে মান্য করে প্রত্ন-আইন।
অথচ উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করা এ দেশে কতিপয় ক্ষমতাধর, নীতিহীন সুবিধাবাদী আর লোভী মানুষের হাতে প্রত্নস্থল আর প্রত্নসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংস্কৃতি হন্তারকদের তালিকায় আছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতাসীন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা শ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব তস্করবৃত্তির অপরাধে প্রত্ন-আইনে দণ্ডের বিধান থাকলেও আইনের ঊধর্ে্ব থেকে যায় অপরাধীরা। আরো বিস্ময় হচ্ছে, প্রত্ন-অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রত্নতত্ত্ব ও শিল্পকলার ছাত্র-শিক্ষক, মিডিয়াকর্মী, সুশীল সমাজের দু-একজন আর পরিবেশবাদী সংগঠন প্রতিবাদ করে। প্রতিবিধানের জন্য কখনো কখনো আদালত এগিয়ে আসেন। অথচ ঐতিহ্য রক্ষায় যেভাবে সরব হওয়ার কথা ছিল ইতিহাসবিদ, ইতিহাসের শিক্ষক-ছাত্রের, ইতিহাস-ঐতিহ্যবিষয়ক সমিতি-সংগঠনগুলোর পরিচালকদের আর দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতি কর্মীদের; তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। তবে কি প্রত্নসংস্কৃতির গুরুত্ব সবার কাছে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে? বিস্ময়কর শোনালেও প্রশ্নটিকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার বয়স দুই দশকের বেশি নয়। এ কারণে শিক্ষিত দায়িত্বশীল অনেকের মধ্যে এখনো প্রত্নতত্ত্ব ও প্রত্ন-ঐতিহ্যের গভীরতা অনুধাবনে অস্পষ্টতা রয়েছে। ইতিহাসবোধটাও কি খুব স্পষ্ট হয়েছে? ডাক্তারি বিদ্যার মতো ইতিহাস যে একটি বিশেষায়িত বিষয়, সেভাবে কি আমরা সব সময় ভেবে থাকি? চোখের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কি হার্টের চিকিৎসা করবেন? আধুনিক যুগপর্বের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিশেষজ্ঞ শিক্ষক কি (ব্যতিক্রম ছাড়া) প্রাচীন বাংলার শিল্পকলা বা তাম্রলিপির ক্লাসে বক্তৃতা করবেন? অথবা মধ্যযুগের আরবি-ফারসি শিলালিপি ও মুদ্রা বিশ্লেষণ করে বা পোড়ামাটির শিল্প কিংবা মূর্তিতত্ত্ব বিচার করে ইতিহাস নির্মাণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে? প্রত্ন-অঞ্চলের সংকট আর অরাজকতা অনুসন্ধান এবং প্রস্তাবনা করার দায়িত্ব কোন পাত্রে অর্পণ করা উচিত, তা কি আমরা ভেবে দেখি?
প্রত্নবস্তু যে একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল এ কথা সবাই মানবেন। প্রত্ন-আইন লঙ্ঘন করে লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরে শুটিং হচ্ছে, হচ্ছে ফ্যাশন শো। মাজারের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাবানরা মহাস্থানগড়ে আড়াই হাজার বছর আগের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ দেশে বড় বড় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অমার্জিত নীরবতা পালন করছে। সংবাদপত্রে দেখেছি, মহাস্থানগড়ে মাজার কমিটির তত্ত্বাবধানে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে প্রত্ন-আইনের তোয়াক্কা না করে পূর্বপুরুষের গড়া হাজার বছরের সংস্কৃতির পাঁজরে গাঁইতি-শাবলের আঘাত পড়ছে। মহাস্থানগড় প্রত্নস্থলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ান তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে অবৈধ তৎপরতায় ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে বলায় এবং সাংবাদিকরা অপতৎপরতার কথা প্রকাশ করায় মাজার কমিটি তথা স্থানীয় সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বিধায়কদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের অজ্ঞতা, লোভ বা মোসাহেবি চরিতার্থের জন্য আবার প্রকাশ্যে জানায়, 'প্রত্ন-আইন মেনেই তারা প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করছে।' প্রত্নতত্ত্ব অনেক বেশি বিজ্ঞানমনস্ক বিশেষায়িত বিষয়। এ অঞ্চলের সংকট অনুধাবন আর মোচনে ভূমিকা রাখার কথা প্রত্নতত্ত্ববিদদের। নিদেনপক্ষে প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ ছাড়া এ অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা সহজ নয়। কিন্তু দায়িত্বশীলদের আচরণে বা নীতিনির্ধারণে বোঝা যায় না, এই সত্য বোঝার দায় কারো আছে। আশার কথা, আমাদের প্রত্নসম্পদ রক্ষার জন্য অনন্যোপায় হয়ে সুশীল সমাজের দু-একজন আদালতের দ্বারস্থ হয়ে লালবাগ দুর্গ ও মহাস্থানগড়ের সমূহ ধ্বংসযজ্ঞকে কিছুটা ঠেকাতে পেরেছেন। তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। আদালত এসব অভিযোগ তাৎক্ষণিক বিবেচনায় এনেছেন, কখনো স্বপ্রণোদিত হয়ে রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সবশেষে মহাস্থানগড় সংকট নিরূপণ ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার জন্য ১০ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে দিয়েছেন। যদিও অভিজ্ঞ মহলের কাছে এই কমিটিকে বিশেষায়িত অঞ্চলে প্রায় বিশেষজ্ঞহীন কমিটি বলে মনে হয়েছে, তবুও আদালতের ইচ্ছা ও আন্তরিকতাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কমিটির বর্ণনা দিতে গিয়ে সব কাগজেই তদন্ত কমিটিতে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষককে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।' কিন্তু আমাদের জানা মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো বিভাগ নেই। তবে যেভাবেই দেখি, বলতেই হবে আমাদের প্রত্নস্থলগুলোয় এখন মাৎস্যন্যায় চলছে। কেউ কারো কথা মানছে না। মাজারকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাবান ভাগীদার রাজনৈতিক নেতা আর প্রশাসনের বিধায়করা ক্ষমতায় ও দাপটে সংস্কৃতির মূলোচ্ছেদ করছেন, আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে রাতের আঁধারে সংরক্ষিত প্রত্নস্থলে মাটি খুঁড়ছেন। প্রত্ন-আইনে স্পষ্ট বিধান থাকলেও অন্যায়কারীর দণ্ড ভোগ করতে হচ্ছে না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সম্পদ রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সাংবাদিকরা অন্যায়ের মুখোশ উন্মোচন করছেন। এ জন্য তারা পুরস্কার না পেয়ে তিরস্কৃত হচ্ছেন। সুশীল সমাজ আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের যেভাবে প্রতিবাদী হয়ে মাঠে নামার কথা, সেভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। স্বাধীন গৌড় রাজ্যের রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর সাত শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলায় নেমে এসেছিল এক শ বছরব্যাপী মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতা। আজ আমাদের অমূল্য প্রত্নসম্পদ ও প্রত্নস্থল নিয়ে যেন তেমন এক মাৎস্যন্যায় শুরু হয়েছে।
আমরা যদি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাই, ঐতিহ্যচর্চার মধ্য দিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিতে চাই, নতুন প্রজন্মকে প্রাণিত করতে চাই, তবে বুক দিয়ে আগলে রাখতে হবে প্রত্নসম্পদ। আমাদের দেশের বাস্তবতায় বলতে হবে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও স্থানীয় প্রশাসনের বিধায়করা যদি প্রত্ন-ঐতিহ্যের গুরুত্ব বোঝেন, দেশের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থাকে; তবে প্রত্নক্ষেত্র রক্ষা পাওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়। আর উল্টোটি হলে কী সংকট দৃশ্যমান হয় মহাস্থানগড়ই এর প্রমাণ। ১৯৯৪-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মহাস্থানগড়ে শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ারের মাজারসংলগ্ন মোগল মসজিদটি ভেঙে আধুনিক মসজিদ বানানোর উদ্যোগে সে সময়ের জেলা প্রশাসক অগ্রণী হয়েছিলেন। সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের প্রবল আপত্তির মুখেও ক্ষমতাবান জেলা প্রশাসক মাজার কমিটির সঙ্গে একাট্টা হয়ে স্মৃতি হিসেবে একটি গম্বুজ রেখে আধুনিক ঝকঝকে মসজিদ বানিয়েছিলেন। এ যুগে এসে আরেকজন জেলা প্রশাসক অসৎ রাজনীতিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিন্ন কাজই করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে শুনেছি, বাগেরহাটের এক দেশপ্রেমিক সংস্কৃতিবোদ্ধা জেলা প্রশাসক খানজাহান আলীর সমাধির কাছে মসজিদ বানানোর জন্য মাজার কমিটির শত চাপকে উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ করব, প্রশাসন ক্যাডারসহ সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে যেন প্রত্ন-ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পদের ওপর পাঠের ব্যবস্থা রাখা হয়। যাতে তাঁরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্ন-অঞ্চলের গুরুত্ব এবং প্রত্ন-আইন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করতে পারেন। কারণ তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। প্রত্নক্ষেত্র এবং প্রত্নসম্পদ সবার আগে তাদের চোখের সামনেই ধ্বংস হয়। তারা যদি প্রথম দেখায় এসব সম্পদের গুরুত্ব বুঝতে পারেন, তবে প্রত্নক্ষেত্র রক্ষা করা অনেকটাই সম্ভব হবে। ধ্বংসের পর আইন-আদালত করার চেয়ে সেটাই কি ভালো নয়?

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.