যুক্তি তর্ক গল্প-মহৎ অভিযাত্রার কথা ভুললে চলবে না by আবুল মোমেন

দেশের রাজনীতি আবারও অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন তোলা যায়—বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আমলে কবেই বা রাজনীতি সচল ছিল? দুই বড় দলের পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতি তো সত্যিকার অর্থে সচল ও সফল হতে পারে না।


কিন্তু এ দেশে বিজয়ী দল বিরোধী দলকে সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনোরকম অংশীদারির সুযোগ দেয়নি। আবার বিরোধী দলও কখনো সরকারকে সহযোগিতা দেওয়ার মনোভাব দেখায়নি। সেই একানব্বই থেকে অসহযোগিতা ও সংঘাতের রাজনীতি বহাল রয়েছে। সেই থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ একইভাবে অবিশ্বাস, বিরুদ্ধতা ও সংঘাতের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে।
মানুষ এ অবস্থায় স্বভাবতই হতাশ ও বিরক্ত। তবে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক পরিমাপ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক ডামাডোল ও সংকটের মধ্যেও দেশের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। আফসোস হলো, ডামাডোল ও সংকটের কারণে অগ্রগতি আশানুরূপ গতিতে ও ব্যাপ্তিতে হয়নি। ফলে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভূত হওয়া অযথা বিলম্বিত হচ্ছে।
তাই আফসোস হয় ঠিকই, কিন্তু আমাদের তো জানা প্রয়োজন, দেশের এই পরিণতি বা রাজনীতির একই চক্করের মধ্যে আবর্তিত হওয়ার কী ব্যাখ্যা হতে পারে? যদি আমরা মনে করি, দুই বড় দল ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত আছে, সরকারের মসনদ দখল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সংগ্রামেই সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে, তবে তাদের কর্মকাণ্ডে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
যেকোনো দেশের শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীই সে দেশের জনমত গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এই শ্রেণী সাধারণত রাজনীতিসচেতন হলেও নিজেদের ভালো থাকা, উত্তরোত্তর ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষার দ্বারাই চালিত হয়ে থাকে। ফলে ক্ষমতা বা সরকার পরিচালনার বাইরে রাজনীতির যে আরও বৃহত্তর কিছু ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে, তা তাদের বিবেচনা থেকে ক্রমে হারিয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ই তাদের বিবেচনায় অগ্রাধিকার পেতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে সমাজপ্রগতির আরও কিছু এজেন্ডা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা বিস্মৃত হয়ে থাকি।
একটু পেছনে ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, আমাদের মূল রাজনৈতিক সংগ্রামগুলো পরিচালিত হয়েছিল স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য। এরই সঙ্গে স্বভাবতই অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয় হয়েছে। সংখ্যালঘুর অধিকার, আদিবাসীর স্বীকৃতি, কৃষক-মজুর ও দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ, প্রতিবন্ধী ও সমাজের অন্যান্য দুর্বল অংশের অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অনেক এজেন্ডাই রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে। একটি জাতি তার ইতিহাস থেকে দেশপ্রেম ও জাতিগত মর্যাদাবোধের উপাদান গ্রহণ করে থাকে। ফলে সেদিক থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।
একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির সঙ্গে এসব বিষয় যুক্ত। কেবল দ্রব্যমূল্য, শুধুই বিদ্যুৎ, নিছক আইনশৃঙ্খলা তার রাজনীতির একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। আদতে আমাদের মতো বিকাশমান সমাজে সমাজ-বিকাশের একটা পর্বে বিরাজমান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীলের মধ্যে বেছে নেওয়ার প্রশ্নটি জরুরি।
বাংলাদেশে বিষয়টি কেবল রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল রাজনীতির দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জামায়াতে ইসলামী ও তার চেয়েও কট্টর অনেক দল রয়েছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। যাদের নেতাদের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধাপরাধীরা রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে কেবল দেশদ্রোহ নয়; হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব দল বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না আইনের শাসন ও মানবাধিকারে। জামায়াতসহ আঠারো দলীয় জোটে এমন দল রয়েছে, যারা একসময় স্লোগান দিয়েছে: ‘আমরা হব তালেবান’/ ‘বাংলা হবে আফগান’। কিংবা এরা অনেকেই বাংলা ভাই এবং হুজির তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের সহায়তা সমর্থন দিয়েছে। বিএনপি দেশের অপর বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কিন্তু তারা জামায়াত এবং এ-জাতীয় দলকে নিয়েই রাজনৈতিক জোট বেঁধেছে, জামায়াতের নেতাদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত, তাঁদের মন্ত্রী বানিয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের স্মারক স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও চাননি, দোষও স্বীকার করেননি, অনুতাপও প্রকাশ করেননি।
দ্রব্যমূল্য কি দুর্নীতি, বিদ্যুৎ কি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মানদণ্ডে বিচার করলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যে পার্থক্য করা হয়তো মুশকিল হবে। সংসদের ভূমিকা, সরকারের কর্মকাণ্ড, উন্নয়নের গতিধারা বিচার করলে এই দুই দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকায় কেবল গুণগত ব্যবধান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে অবশ্যই। কিন্তু এটাই কি সব কথা? এটাই কি শেষ কথা?
না, এটাই শেষ কথা, সব কথা নয়। মিসর, আলজেরিয়া, এমনকি তুরস্কের মতো আধুনিক মুসলিম দেশেও সত্যিকারের একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে না ওঠায় সামরিক বাহিনীর চাপ না থাকলে এসব দেশে কট্টর রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদীরাই ক্ষমতায় চলে আসে। এরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। আমি অনেক সময় বিভিন্ন সেমিনারে বলেছি, যদি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটি না থাকে, তবে এ সমাজে দ্রুত তালেবানি রাজনীতির উত্থান ঘটবে এবং আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বিপর্যস্ত হবে। কেবল ২০০১-২০০৬ আমলের কথাই ভাবুন, তখন বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতায় ছিল জামায়াত। তখনই এ দেশে বাংলা ভাই ও হুজির উত্থান হয়েছে। আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগগুলো ঘটেছে ও সক্রিয় থেকেছে। তখন তারা সরকারের মদদ পেয়েছে এবং উত্তরের বিস্তীর্ণ জনপদে তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কায়েম করেছিল। সে সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ছায়ানট, উদীচী, সিপিবি প্রত্যক্ষ আক্রমণের শিকার হয়েছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারের বিচারক খুন হয়েছেন, আদালত আক্রান্ত হয়েছে, খোদ মদদদানকারী সরকারও আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। এর কারণ, তাদের তো সত্যিই তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা রয়েছে।
এ কথাও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষকে মনে রাখতে হবে, যদি দেশে আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটি না থাকত, তবে তার কট্টর সমালোচক অতিবাম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের তো বটেই, শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তার যেকোনো মানুষের পক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করা, সোজা কথায়, বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। আমরা একাত্তরে বদরবাহিনীর ভূমিকা দেখে আর সম্প্রতি হুমায়ুন আজাদের পরিণতি দেখে সেটা বুঝতে পারি। তারা শত্রু চিনতে ভুল করে না।
ফলে চাল-তেলের দাম, বিদ্যুৎ সরবরাহ আর চুরি-ছিনতাই-খুনের হাত থেকে মুক্তির পাশাপাশি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। আর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে কট্টর ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সনাতন ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে জ্ঞান, যুক্তি ও মানবতার আলোর বিস্তার ঘটাতে হবে। সমাজের সব মানুষের জন্য বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সমাজে অগ্রসর চিন্তা, বিপ্লবী চিন্তা, প্রথা ভাঙার উদ্যোগ, নতুন নিরীক্ষার সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। প্রশ্ন করা, কৌতূহল জাগ্রত করা, বিতর্ক করার অবকাশ তৈরি করতে হবে। তরুণদের জিজ্ঞাসু, সৃষ্টিশীল মানস বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এসবও দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, বিদ্যুৎ বা আইনশৃঙ্খলার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রতিদিনের বাজার, বিদ্যুতের ভেলকি, দুর্নীতির শতেক কেচ্ছা, অপরাধের নোংরা ও ভয়াবহ ঘটনা আমাদের নিশ্চয় বিরক্ত ও হতাশ করবে। আমরা নিশ্চয় ব্যর্থতা ও অন্যায়ের সমালোচনা করব। কিন্তু তাই বলে দিনযাপনের গ্লানিতে ছোট হতে হতে মানুষের মহৎ অভিযাত্রার কথা ভুলে যাব না। ইতিহাসের কোন স্তরে কোন পর্যায়ে আমরা আছি, তা ভুলে বসব না।
আমাদের ধৈর্য ধরে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধতার বিষবৃক্ষ কাটতে হবে, জঙ্গি ইসলামের ভ্রান্তি থেকে সম্পূর্ণ বের হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিভ্রান্তি বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে, এখানে বসতি স্থাপনকারী সকল ক্ষুদ্র জাতিকে, এ অঞ্চলের ইতিহাসের বড় অর্জনগুলো জানতে হবে।
হ্যাঁ, বিদ্যুৎও লাগবে, মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়াতে হবে, অপরাধ ও দুর্নীতি রোধ করতে হবে। এবং অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও এ অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-আদিবাসীর অবদানে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে আস্থাশীল বিরোধী রাজনৈতিক দলও দাঁড় করাতে হবে, যারা ক্ষমতায় গেলে দেশের ইতিহাস পাল্টাবে না, আধুনিক গণতন্ত্র ছেড়ে ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদীর মিছিলে দেশ শামিল হবে না, মুক্তচিন্তা ও যুক্তির পথ অন্ধবিশ্বাসের কাছে বলি হবে না।
এ বিষয়গুলো দেশের বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও পেশাজীবীদের ভাবতে হবে। নয়তো হতাশার কথা আর বিরক্তিকর প্রতিক্রিয়ায় আমরা কেবল থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় করতে থাকব।
আমাদের পরিস্থিতি আসলে সে রকম নয়, বুঝতে ভুল হচ্ছে আমাদের।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.