শ্যুটিং-পরবাস

অলিম্পিককে সামনে রেখে প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশের দুই শ্যুটার শারমিন আক্তার রত্না এবং তৃপ্তি দত্ত এখন লন্ডনে। তাঁদের লন্ডন অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন মাসুদ আলম কাঠের একতলা বাড়ি। কাঠের পিলারে ভর দিয়ে মাটি থেকে একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে। যেন পুরোনো স্থাপত্যকলার নিদর্শন।


থাকার জন্য অন্য রকম অভিজ্ঞতাই হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে থাকতে নাকি গা ছমছম করে!
সবচেয়ে বড় কারণ—বিশাল এলাকায় কয়েক শ একরের মধ্যে জনবসতি নেই। সূর্য ডুবে রাত ১০টায়। কিন্তু সাতটার মধ্যে সব বন্ধ। সব গুটিয়ে সবাই চলে যায়। রাতে কেউ আসে না। বিসলে শ্যুটিং রেঞ্জের নির্জন এই পরিবেশ বাংলাদেশের চার শ্যুটিং-কন্যার মনে ভয়ই ধরিয়ে দিয়েছিল এবং এখনো দিচ্ছে।
‘ধরিয়ে দিয়েছিল’ বলার কারণ চারজনের মধ্যে শারমিন আক্তার ও সাদিয়া সুলতানা ফিরে এসেছেন। এখন সেখানে আছেন শারমিন আক্তার রত্না ও তৃপ্তি দত্ত। অলিম্পিক গেমসকে সামনে রেখে অনুশীলনের জন্য চারজন সেখানে গিয়েছিলেন গত ১৯ এপ্রিল। কিন্তু অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখে কিছুদিন পরই দুজনকে ফিরিয়ে এনেছে সফরের আয়োজক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন। শারমিন রত্না ওয়াইল্ড কার্ডে অলিম্পিকে সুযোগ পাচ্ছেন। তৃপ্তির জন্য আরেকটি ওয়াইল্ড কার্ডের চেষ্টা চলছে। তাই তাঁদের দুজনকে রেখে দেওয়া।
উপলক্ষ অলিম্পিক, স্বপ্ন পূরণের হাতছানি। সঙ্গে প্রাপ্তি বিসলে শ্যুটিং রেঞ্জে থাকার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। যা খণ্ড খণ্ডভাবে মিলিয়ে নিলে বড় এক গল্পই হয়ে যায়। বিসলে শ্যুটিং রেঞ্জের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ের আছে আত্মার বন্ধন। ২০০২ ম্যানচেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে দশ মিটার এয়ার রাইফেলে আসিফ হোসেন খান সোনা জিতেছিলেন এই রেঞ্জেই। শ্যুটারদের এই সফরটা সেটিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার।
মনে পড়ছে আসিফকে নিয়ে বিসলেতে কী আনন্দই না ছিল বাংলাদেশিদের! আসিফ তখন ১৬ বছরের কিশোর। তাঁর অপ্রত্যাশিত সোনা জেতার খবর শুনে ম্যানচেস্টার থেকে সবাই ছুটল বিসলেতে। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। বাংলাদেশের এক কিশোর তখন কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে এক বিস্ময়।
এবার সেই রেঞ্জে পা রেখে বিস্মিত শারমিনরা। বিস্মিত এই কারণে যে ওখানে তাঁরা ছাড়া আর কেউ থাকে না। শনি-বোরবার কিছু শৌখিন শ্যুটার আসেন। তাঁরা ফি দিয়ে অনুশীলন করে চলে যান।
টেলিফোনে শারমিন রত্না বলছিলেন, ‘জায়গাটা রাতের বেলা ভুতুড়ে বাড়ির মতো। লোকজনের দেখা পাওয়াই দুষ্কর। দেখা হলে হাই-হ্যালোতেই শেষ।’
বাংলাদেশ থেকে গিয়েই শ্যুটাররা পড়েছেন কনকনে ঠান্ডায়। শুরুর দিকে বৃষ্টি হতো নিয়মিত। গরমের দেশের বাসিন্দাদের কাছে ঠান্ডাটা একেবারে অসহনীয়। শীতের কারণে প্রথম দিকে নাক দিয়ে রক্তও পড়েছে তাঁদের, এখন অবশ্য আবহাওয়া কিছুটা সহনীয়।
শারমিনদের আবাস থেকে রেঞ্জ কয়েক মিনিটের পথ। এটুকু পথ যেতে প্রায়ই পেরোতে হয় বৃষ্টির বাধা। ছাতা মাথায় দিলেও বাতাসে নাকি উড়ে যায়। এভাবে সবারই নাকি কয়েকটা করে ছাতা কেনা হয়ে গেছে!
তিন হাজার মিটার জায়গাজুড়ে বিশাল রেঞ্জ। শ্যুটার ম্যালকম কুপারের নামে বিখ্যাত এই রেঞ্জে আছে কিছু গানশপ, যা চোখ কাড়ে। এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা শ্যুটিং রেঞ্জ। লন্ডন থেকে গাড়িতে যেতে ৪৫ মিনিট লাগে। গিয়েই একবার লন্ডন যাওয়া হয়েছে শারমিনদের। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আসিফের এক বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়া।
ওখানকার সবচেয়ে কাছের শপিং মলে হেঁটে যেতে ৪৫ মিনিট লাগে। তা যেতেই পেরোতে হয় বন-জঙ্গল। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সেদিকে খুব একটা পা বাড়াননি শ্যুটাররা। তাঁরা বরং ভেতরেই থাকেন এবং উপভোগ করেন এর বহুমাত্রিক দিকটা, ‘আমাদের এই বাড়ির সামনেও প্রচুর ক্যারাভান পড়ে আছে। দেখলেই সিনেমার কথা মনে হয়। ভয়ে থাকি কখন না ভূতের সামনে পড়ে যাই’—বলছিলেন শারমিন।
তাঁদের দেখাশোনার জন্য একজন ইংলিশ ভদ্রমহিলা আছেন। প্রথম দিকে তিনি রেঞ্জে আসতেন। এখন আর অবশ্য সেভাবে আসতে পারেন না। ফোনে তাঁর সহযোগিতা নিতে হয়। খাওয়ার ব্যবস্থা রেঞ্জের ভেতরেই। তবে বাংলাদেশের মেয়েদের খাওয়ার তৃপ্তি ওই ইংলিশ খাবারে মেটে? সবই মসলাহীন। তাই তাঁরা মাঝে মাঝে রান্না করে খান। বেশির ভাগ সময় ডিম ভাজি-সাদা ভাত, সবজি...।
তবে কত খাবারের নাম যে নতুন শুনলেন! লনটোস, পাপাডাঙ্গা...। ‘রেস্টুরেন্টের এক মহিলা আমাদের প্রতি বেশ সদয়। একদিন জোর করে পিৎজা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। বললেন এখানকার মাংস তো হালাল না। তোমাদের ফিস খাওয়াই। পরে দেখলাম আমরা অক্টোপাস খাচ্ছি!’ বলতে বলতে হেসেই খুন এসএ গেমসে ব্যক্তিগত ও কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে দলীয় সোনা জেতা শারমিন।
মজার ব্যাপার আছে আরেকটি—বাংলাদেশের মেয়েরা কয়েকজন একসঙ্গে থাকলে হাত ধরে হাঁটে। হাসিঠাট্টা করে। এটা অনেক বিদেশি আগ্রহ নিয়ে দেখে। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও এখন তাঁরা বোঝেন, বিষয়টিকে অন্য চোখে দেখে ওখানকার মানুষ।
একজন একটু ব্যতিক্রম। বাঙালি ব্রিটিশ। পুলিশ অফিসার। ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন। তাও সিলেটি বাংলায়, ‘তোমরা বালা আছনি।’
শারমিনদের সবচেয়ে ভালো সময় কাটে ইন্টারনেটে, যখন শ্যুটিং শেষ করে দেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে দুদণ্ড গল্প করা যায়। বাংলাদেশে তখন গভীর রাত। চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও গল্পে ইতি টানতে হয়। মন ভরে না।
অতৃপ্তিও ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁদের—বিদেশি কোচ না পাওয়া। কোচিং করাচ্ছেন দেশি কোচ শোয়েবুজ্জামানই। তবু শারমিন বলছেন, ‘লন্ডনের মতো জায়গায় অনুশীলনের সুযোগ করে দেওয়ায় জন্য বিওএর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’
তাঁদের কৃতজ্ঞতা বিওএর প্রাপ্যই। নইলে এমন অভিজ্ঞতা কি হতো শ্যুটারদের!

No comments

Powered by Blogger.