ভাষা প্রতিযোগ-প্রতিযোগিতায় পুরস্কারে উদ্দীপনাময় দিন by আশীষ-উর-রহমান

মাতৃভাষাকে নিয়ে নবীন প্রাণের প্রত্যয় আর অগ্রজদের অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে এক উদ্দীপনাময় দিন কাটল গতকাল শনিবার রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সারা দেশ থেকে আসা প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ছুটির মৌনতা ঘুচিয়ে দিয়ে দীপ্ত প্রাণের উচ্ছ্বাসে মুখর করে তুলেছিল প্রাঙ্গণ।


সমবেত হয়েছিল তারা এইচএসবিসি-প্রথম আলো অষ্টম ভাষা প্রতিযোগের জাতীয় প্রতিযোগিতায়।
নাম নিবন্ধনের পালা শুরু হয়েছিল সকাল আটটায়। প্রাঙ্গণের এক পাশ দিয়ে সুসজ্জিত স্টল করা হয়েছিল প্রতিটি অঞ্চলের জন্য। এবার ঢাকাসহ মোট নয়টি অঞ্চলে এই প্রতিযোগ আয়োজিত হয়েছিল। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া থেকে শুরু। এরপর পর্যায়ক্রমে নাটোর, ঠাকুরগাঁও, ঝালকাঠি, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা অঞ্চলে প্রতিযোগ সম্পন্ন হয়েছে। সারা দেশের আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। আঞ্চলিক পর্যায়ের বিজয়ীদের নিয়ে গতকাল ঢাকায় হলো জাতীয় প্রতিযোগিতা। এতে অংশ নিয়েছে চার শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে অভিভাবক এবং শিক্ষকেরাও এসেছিলেন ওদের প্রেরণা দিতে।
সকাল নয়টায় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম। ভাষা প্রতিযোগের পতাকা উত্তোলন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো প্রতিযোগীরা তাদের হাতে ধরা শত শত রঙিন বেলুন উড়িয়ে দেয়। আকাশের একটুকরো তখন হরেক রঙের বিন্দুতে বর্ণিল।
নবীন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে আনিসুজ্জামান বলেন, ভাষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে মানুষ অন্য প্রাণীদের চেয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। তবে ভাষা কেবল মনোভাব প্রকাশের মাধ্যমই নয়, সভ্যতা বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও একটি বড় শক্তি। এই শক্তি কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ করে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
মঞ্জু আরা বেগম তাঁদের প্রতিষ্ঠানটিতে এই মহতী অনুষ্ঠান আয়োজন করায় প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ ধরনের আয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষার চেতনা বিকাশ এবং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
এর আগে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এ প্রতিযোগিতায় যারা অংশ নিয়েছে, তাদের অভিনন্দন। তবে এখানে বিজয়ী হওয়াটাই চূড়ান্ত বিজয় নয়। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের দায়িত্বও তাদের হাতে। সেখানেও তাদের বিজয়ী হতে হবে। সেটিই হলো প্রকৃত বিজয়। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক অরুণ বসু।
সংক্ষিপ্ত এই উদ্বোধনী পর্বের পরেই শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা নিয়ে তাদের মনে তো কোনো ভীতি ছিলই না, বরং ছিল জয়ী হওয়ার আনন্দ লাভের একটি প্রক্রিয়া। আয়োজনের এসব বিষয়ের চমৎকার ব্যবস্থাপনা করেছিলেন প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা।
প্রতিযোগিতার পর ছিল এই আয়োজনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব। খুশিতে মেতে ওঠার বৈচিত্র্যময় বিষয়। এ বছর মহান ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর পূর্ণ হলো। এ পর্বের সঞ্চালক প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাশিল্পী আনিসুল হক জানালেন, এবারের ভাষা প্রতিযোগে ভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পূর্তিতে বিশেষভাবে স্মরণ করা হচ্ছে ভাষাসৈনিকদের সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে। মিলনায়তনের মঞ্চটিও সাজানো হয়েছিল ফুল, ভাষা প্রতিযোগের বিগত আসরগুলোর কার্যক্রমের ছবিসংবলিত ডিজিটাল ব্যানার আর ভাষাশহীদদের প্রতিকৃতি দিয়ে। ভাষাসৈনিক রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক ও শিল্পী মুর্তজা বশীরকে অনুরোধ জানানো হলো মঞ্চে আসতে। তাঁরা মঞ্চে এলে সবাই দাঁড়িয়ে করতালির মধ্য দিয়ে ভাষাসৈনিকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
আহমদ রফিক সংক্ষেপে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ‘নিজেদের ইতিহাস না জানলে জাতি হিসেবে এগোতে পারব না।’ একই সঙ্গে তিনি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের আহ্বান জানান।
মুর্তজা বশীর ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তমাখা দিনের স্মৃতিচারণা করে নবীনদের শোনান, কীভাবে তাঁদের সামনেই মায়ের ভাষার জন্য বরকত-সালামরা রাজপথে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।
এরপর ছিল গান। শিল্পী চন্দনা মজুমদার শোনালেন লালনের ‘কে বানাইল এমন রংমহল খানা’ এবং মনপুরা ছবির ‘সোনার পালঙ্কে’। ঢাকার বাইরে থেকে আসা প্রতিযোগীদের অনেকেই ফিরে যাবে বলে দ্রুত শেষ করার তাড়া ছিল। তাতে সময় কাটা পড়ল বক্তাদের। শুরুর আগেই সঞ্চালকের সতর্কসংকেত। অল্প কয়েক কথায় তাঁরা বারবার তাগিদ দিলেন শুদ্ধ করে বাংলা ভাষা বলতে ও লিখতে। বললেন, অন্য ভাষাও শিখতে হবে, তবে মাতৃভাষা শুদ্ধ করে শিখতে হবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে। তবেই ভাষার মর্যাদা বাড়বে। এ পর্যায়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ভীষ্মদেব চৌধুরী, মাহবুবুল হক, দানিউল হক।
আলোচনার মাঝেমধ্যে এসে গান শুনিয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পীরা। প্রতিযোগীরাও অংশ নিয়েছে কেউ কেউ। শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় শোনান ‘বাংলাদেশের মেঠোপথে’ ও ‘তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল’। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করেন অরুণ বসু। চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠের ইমরান গেয়ে শোনান ‘আমার প্রাণের বাংলা’। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রতিযোগী সিফাই-ই-মনজুর গেয়ে শোনায় আঞ্চলিক ভাষার গান ‘দিনাজপুরে ভাই বেড়াতে যান’। ‘যে মাটির বুকে’, ‘তোমরা একতারা বাজাইও না’সহ কয়েকটি গান শোনান শিল্পী কিশোর।
আলোচনা পর্ব সংক্ষিপ্ত হলেও এমন কেউ কেউ থাকেন, যাঁদের সামনে পেলে গান শোনার চেয়ে তাঁদের কথা শুনতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শ্রোতারা। তেমন বক্তাও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে প্রথমে মঞ্চে এলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি প্রথমেই সবাইকে জানিয়ে দিলেন, ভোর ছয়টা ৪১ মিনিটে ওয়াসফিয়া নাজরীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী, জয় করেছেন এভারেস্ট শৃঙ্গ। তাঁর জন্য করতালি। শিক্ষার্থীদের বললেন, ‘আমাদের সমতল ভূমির ছেলেমেয়েরা এখন পর্বতচূড়ায় উঠতে শিখে গেছে। কাজেই, আমি খুবই আশাবাদী যে এ দেশের নবীন প্রজন্ম একদিন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেই।’
তার পরই এলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সরস গল্প আর কথার জাদুতে মাতিয়ে দিলেন তিনি বরাবরের মতো। গল্পে গল্পে শিক্ষাও দিলেন যে, শুদ্ধ করে মাতৃভাষা শেখার আসলে কোনো বিকল্প নেই। সে কাজটি নবীনদের করতে হবে। এরপর দুপুরের খাবারের বিরতি।
শেষ পর্বটি শুরু হয়েছিল বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিযোগীদের পরিবেশনা দিয়ে। তাদের কেউ গান শুনিয়েছে, আবৃত্তি করেছে কেউ। জমে উঠেছিল দারুণ। আমন্ত্রিত শিল্পীদের মধ্যে শারমিন সাথী ইসলাম শোনালেন দুটি নজরুলসংগীত ‘শান্তির জয় হোক, সত্যের জয় হোক’ এবং ‘আমি ভাই খ্যাপা বাউল’। পরে অদিতি মহসিন পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত ‘বরিষ ধরা মাঝে’ এবং ‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে’। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে আসেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, ক্রিকেটার ইলিয়াস সানি ও এনামুল হক জুনিয়র। এই পর্বের সঞ্চালনা করছিলেন বন্ধুসভার জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন। তিনি বললেন, ‘অকালপ্রয়াত শিল্পী আবিদ শাহরিয়ার নিয়মিত এই আয়োজনে অংশ নিয়ে গান শুনিয়েছেন। তাঁর স্মৃতি স্মরণ করে কেউ কি ওর গাওয়া কোন গান গাইবে?’ সিলেটের শাহিদা শোনাল ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’।
ভাষা প্রতিযোগের এবারের সমন্বয়ক তারিক মনজুর আয়োজনের সার্বিক দিক তুলে ধরেন। এ পর্বের শেষ বক্তা এইচএসবিসির বিপণন ও যোগাযোগপ্রধান তালুকদার নোমান। এ আয়োজনে তাঁর প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত থাকতে পারায় নিজেদের গৌরবান্বিত বোধ করে বলেন, বাংলা ভাষার গৌরব আরও বাড়বে নতুন প্রজন্ম যখন বিশ্বদরবারের মর্যাদার আসনে স্থান করে নেবে। এ জন্য সবাইকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে সেই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে হয় অনুষ্ঠানের সমাপনী। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মঞ্জু আরা বেগম, সৈয়দ আজিজুল হক, মাহবুবুল হক, জুয়েল আইচ, তালুকদার নোমান ও সাজ্জাদ শরিফ। প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—এই চার বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের হাতে ক্রেস্ট, সনদ ও উপহার হিসেবে বইয়ের প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়। এবার এই চারটি বিভাগে সম্মিলিতভাবে শ্রেষ্ঠ স্থানটি অধিকার করেছে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের তাহমিদ আহমেদ; দ্বিতীয় হয়েছে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সুদীপ সেন এবং তৃতীয় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের জান্নাতুল ফেরদৌস। এবারে অনুষ্ঠানকেন্দ্রের জন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সেরা আয়োজনের জন্য ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের জেলা প্রতিনিধি ও বন্ধুসভাকে দুটি বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। বেলা পড়ে এসেছিল। পুরস্কার হাতে নিয়ে অতিথিদের সঙ্গে ছবি তুলেই বাড়ির পথে দে ছুট।

No comments

Powered by Blogger.