৯ পুলিশ সাময়িক বরখাস্ত, এসি প্রত্যাহার-তিন সাংবাদিককে পেটাল পুলিশ

প্রকাশ্য রাজপথে একজনকে ঘিরে ধরে রীতিমতো উৎসব করে পেটাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। একজন কলার ধরে আছেন, কেউ ঘুষি আবার কেউ লাথি মারছেন। পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তা দেখছেন। এগিয়ে গিয়ে পুলিশের মাঝখানে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় নিজের সহকর্মী সাজিদ হোসেনকে দেখতে পান প্রথম আলোর আলোকচিত্র সাংবাদিক জাহিদুল করিম।


এবার তাঁকেও ঘিরে ধরে পেটাতে থাকে পুলিশ। খবর পেয়ে ছুটে যান প্রথম আলোর আরেক আলোকচিত্র সাংবাদিক খালেদ সরকার। ক্যামেরা দেখেই তেড়ে এলেন পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) শহীদুল ইসলাম। ‘দে ক্যামেরা, দে’ বলে চিৎকার করেন তিনি।
ভয় পেয়ে খালেদ ক্যামেরা দিয়ে দেন। এরই মধ্যে কিছু ছবিও তুলে ফেলেন তিনি। ক্যামেরা দেওয়ার পরও পুলিশ কিল-ঘুষি-লাথি মেরে মুহূর্তেই তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। মুঠোফোনে ভিডিওচিত্র তুললে প্রথম আলোর প্রদায়ক ইমাম হাসানকেও মারধর করে পুলিশ। পরে তাঁর মুঠোফোন নিয়ে মেমোরি কার্ড খুলে নেয় পুলিশ।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ছাত্রীদের বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের নির্মমতার শিকার হন প্রথম আলোর তিনজন আলোকচিত্র সাংবাদিক। তাঁরা হলেন খালেদ সরকার, জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন। তাঁদের দ্রুত রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়া হয়। পরে তাঁদের ট্রমা সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। তাঁদের তিনজনেরই গোটা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। ঠোঁট, মুখ কেটে গেছে জাহিদুল করিমের। তিনজনেরই ক্যামেরা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন এসি শহীদুল। তাঁদের শেরেবাংলা নগর থানায় দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে বলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর খবর পেয়ে সহকর্মীরা থানা থেকে তাঁদের উদ্ধার করেন।
এ সময় পঙ্গু হাসপাতালে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা জড়ো হন। তাঁরা সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং জড়িত এসি শহীদুলসহ পুলিশ সদস্যদের বিচার ও শাস্তির দাবি করেন।
এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) পুলিশের নয় সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। আর ঘটনার মূল হোতা এসি শহীদুলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে এক সদস্যের কমিটি করেছে ডিএমপি।
এদিকে, এসি শহীদুলের বিরুদ্ধে আহত সাংবাদিকেরা এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও আহত ফটোসাংবাদিকেরা বলেন, ছাত্রীদের অবরোধের কারণে সড়কের এক পাশে যানজট থাকায় আরেক পাশ দিয়ে র‌্যাবের একটি ভ্যানের পিছে পিছে ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন সাজিদ হোসেন। এ সময় মোড়ে থাকা কয়েকজন পুলিশ তাঁকে থামতে সংকেত দেন। তিনি থেমে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অবরোধের ঘটনার ছবি তুলতে যাচ্ছেন বলে জানান। কথা বলার একপর্যায়ে বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। এ সময় এসি শহীদুল ইসলামসহ দুজন পুলিশ সাজিদের শার্টের কলার ধরে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে আনেন। লাথি দিয়ে ফেলে দেন মোটরসাইকেলটি। মারতে শুরু করেন এসি শহীদুল। সঙ্গে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরাও সাজিদকে মারধর শুরু করেন। ঘটনাস্থল থেকে ফেরার পথে সহকর্মীকে মারতে দেখে জাহিদুল করিম এগিয়ে গেলে তাঁর ওপরও হামলে পড়ে পুলিশ। জাহিদুলকে মারতে দেখে ছবি তোলেন খালেদ সরকার। ছবি তুলতে দেখেই শহীদুল এগিয়ে এসে খালেদের ক্যামেরাটি চান। পুলিশের একই নির্মমতার শিকার হন খালেদ। তাঁদের তিনজনের কাছ থেকেই ক্যামেরা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেবাংলা নগর থানায়।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে এসি শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ও মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিল। আমার এএসআই বাধা দিচ্ছিল। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। দেখে আমি দৌড় দিই। আমার সঙ্গে ফোর্স ছিল। তারাও দৌড় দেয়। তখন আমার সঙ্গে তার হট টক শুরু হয়ে যায়। বুঝেনই তো, মেজাজ কন্ট্রোলে রাখা খুব টাফ হয়ে গিয়েছিল। পেছনে যারা ছিল, তারা এসে ওদের মোটরসাইকেল থেকে নামাচ্ছিল। এ সময় ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে ও পড়ে যায়। এতে হাত-পা ছিলে যায় মনে হয়। তবে আমি নিজের হাতে কাউকে মারি নাই।’
পঙ্গু হাসপাতালে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমাম হোসেন, ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) মাসুদুর রহমানসহ পুলিশ কর্মকর্তারা আসেন। সাংবাদিকেরা তাঁদের কাছে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি করেন।
নয়জন বরখাস্ত: এ ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের পর ডিএমপি একজন উপপরিদর্শক (এসআই), দুজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও ছয়জন কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তেজগাঁও বিভাগের এসি শহীদুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে ডিএমপির সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুদুর রহমান এসব তথ্য জানান। ঘটনা তদন্তে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার শাহাবুদ্দিন কোরেশিকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন এসআই জহির, এএসআই শফিক ও নাজমুল, কনস্টেবল মতিউর, রাজ্জাক, শাহজাহান, জয়নাল, রতন ও জাহাঙ্গীর।

No comments

Powered by Blogger.