নির্বাচন বর্জন বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল-নিজেকে কোরবানি দিয়েছি তৈমুর আলম by লোটন একরাম ও হাসান শিপলু

নিজ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে ঠেকাতেই 'মূলত' শেষ মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগের সমর্থনবঞ্চিত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ের পথ 'সুগম' করে দিতে এ 'কৌশলী' ভূমিকা গ্রহণ করে দলটির হাইকমান্ড। বিনিময়ে ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির রাজনৈতিক 'সুবিধার' কথা চিন্তা করে এ নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। দলের একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।


একই সঙ্গে দলীয় সরকারের অধীনে 'সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়' বলে দলের বর্তমান অবস্থানও 'প্রমাণ' করতে চায় বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন কমিশন চাইলেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন
করতে পারবে না_ নাসিক নির্বাচনই তার প্রমাণ বলে দেখাতে চায় দলটি। এ ছাড়া দলীয় মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের পরাজয়ের আশঙ্কা এবং আগে থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (্ইভিএম) ভোটগ্রহণের বিরোধিতার বিষয়টিও নির্বাচন বর্জনের অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজয়ের পাশাপাশি নাসিক নির্বাচনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক 'ইস্যু'ও করতে চাইছেন তারা। এক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির 'যৌক্তিকতা'ও প্রমাণ হয়েছে বলে প্রচার চালাবে দলটির হাইকমান্ড। বিএনপি নেতারা এটাও মনে করেন, সেনাবাহিনী ছাড়া এবং ইভিএমে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হলে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে দাবি করত আওয়ামী লীগ। আবার হেরে গেলে সরকারি দল বলত, জনমত এখনও আওয়ামী লীগের পক্ষেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়_ এটা আবারও প্রমাণ হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনকে যতই শক্তিশালী করা হোক না কেন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে বোঝা গেছে, কমিশন চাইলেই সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে কাজে লাগাতে পারবে না। সরকারকে একটি নীলনকশার নির্বাচনের বৈধতা দেওয়া থেকে বিরত থাকতেই বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
ভোটগ্রহণের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে শনিবার মধ্যরাতে বিএনপি আকস্মিকভাবে নাসিক নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় সারাদেশে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের নেপথ্য কারণ জানার চেষ্টা করছেন সবাই। কেউ বলছেন, নির্বাচন বয়কট করে ভুল করেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের দুই নেতা প্রার্থী থাকায় মাঝখান দিয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। আবার কেউ বলছেন, তৈমুর বিজয়ী হতে পারবেন না জেনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেত্রী মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ করে তাকে সমর্থন দিতে পারে বিএনপি।
অবশ্য বিএনপির অভ্যন্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার সিদ্ধান্তের পর দু'দিন নির্বাচনী মাঠের খোঁজখবর নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রাজনৈতিক কৌশলও রয়েছে। শনিবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত নেতা স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানসহ অন্য নেতাদের জরুরি বৈঠকে ডাকেন।
বৈঠকে নেতারা জানান, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় শামীম ওসমানের সমর্থকরা তৈমুরের সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তৈমুরের মতো 'দুর্বল' প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয় বলে জানান তারা। এক্ষেত্রে বিএনপির ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হলে ভবিষ্যতে বিএনপি 'লাভবান' হতে পারে বলে মত দেন তারা। আইভী আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ না দেওয়ায় তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয় বলে মত দেন খালেদা জিয়া। নেতারা বলেন, দল সমর্থিত প্রার্থীকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে নিলে বিএনপির ভোট আইভীর প্রতীকেই পড়বে। আইভী যোগ না দিলেও স্থানীয় রাজনীতিতে বিএনপির প্রতি 'দুর্বল' থাকবেন। তাছাড়া শামীমের মতো একজন 'গডফাদার' বিজয়ী হলে আগামীতে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বেকায়দায় পড়তে পারে বিএনপি। একই সঙ্গে সার্বিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ কষে রাত পৌনে ১টায় ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন এবং তৈমুরকে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন খালেদা জিয়া।
শুরু থেকেই কৌশল খুঁজছিল বিএনপি :নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই নাসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল বিএনপি। কার্যত শক্তিশালী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান এবং অন্য প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হওয়ার মতো শক্তিশালী নেতা নেই বিএনপিতে। সেক্ষেত্রে আইভীকে দলে টেনে সমর্থনদানের চেষ্টাও করেছিল দলটি। তাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তৈমুরকে নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং আওয়ামী লীগের ভোট আইভী ও শামীমের মধ্যে ভাগাভাগি হলে মাঝে তৈমুর বিজয়ী হতে পারেন বলে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল দলটি। তবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের পরও সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে ধারণা করেন তারা।
এ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী ছাড়া নির্বাচনকে বৈধতা না দিয়ে 'রাজনৈতিক সুবিধা' নেওয়ার 'কৌশল' গ্রহণ করে বিএনপি হাইকমান্ড। তারা সংবিধানের ১২৬ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না দেওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলতে পারবেন। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে দলীয় সরকার অনুরূপভাবে ইসির ক্ষমতা অমান্য করবে বলে নিজেদের দাবির পক্ষে জোরাল যুক্তি তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন। তবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে তৈমুর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না থাকায়।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান সমকালকে বলেন, সেনা মোতায়েন না করে সংবিধান লঙ্ঘন এবং নির্বাচন কমিশন কোনো অঘটনের দায়-দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান সমকালকে বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। এ পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
বিএনপির অন্য যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লা বুলু বলেন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের পরও সেনা মোতায়েন না করায় প্রমাণ হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হবে না।
সরে দাঁড়াতে চাননি তৈমুর :নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি ছিলেন না বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। শুক্রবার সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত বাতিলের পরও নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকার বিষয়ে অনড় ছিলেন তিনি। কেন্দ্র থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান যোগাযোগ করলেও তৈমুর নির্বাচন করতে চান বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। সর্বশেষ শনিবার মধ্যরাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মোবাইল ফোনে তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন।
তৈমুরের বক্তব্য :তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, আমি নির্বাচন থেকে সরে যেতে চাইনি। দলের চাপেই সরে যেতে হলো। আমি সম্পত্তি বিক্রি করে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। সরে যাওয়াতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। বিকেলে মাসদাইরের বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি এসব কথা বলেন। রোববার সারাদিন তিনি বাসায় ছিলেন।
নির্বাচনের দিন সকাল ১১টার পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী এবং তার কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষুব্ধ মনোভাব ব্যক্ত করেন তৈমুর। বলেন, এবারের নির্বাচনে তার নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত ছিল; কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে তাকে সরে দাঁড়াতে হলো। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্দেশ না দিলে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতেন না।
তিনি বলেন, এর আগে পৌরসভা নির্বাচনে প্রশাসক নিয়োগ করে তাকে মেয়র হতে দেওয়া হয়নি। এবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলে আবার বঞ্চিত করা হলো।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় দল থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি কোনো প্রতিশ্রুতির তোয়াক্কা করেন না। দল সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাই মেনে নিয়েছেন। ঢাকায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই।
বিএনপির সিদ্ধান্ত ভুল ছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি দলের সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

No comments

Powered by Blogger.