অবশেষে ক্যারিবীয় পেস বনাম বাংলাদেশি স্পিন by নোমান মোহাম্মদ

প্রথম দিন ৫ উইকেটে ২৫৩ রান। ব্যাটিং-স্বর্গ বলে উইকেটের তখন সে কী গুণকীর্তন! বাংলাদেশের স্বস্তি, এমন আয়তক্ষেত্রে ক্যারিবীয় ইনিংসের অর্ধেকটা মুড়িয়ে দিতে পেরে। সংবাদ সম্মেলনে দলের মুখপাত্র হয়ে শাহরিয়ার নাফীস জানিয়ে গেলেন, ক্যারিবীয় রানের পাহাড়ের জবাব দিতে প্রস্তুত তারা। অতএব, প্রাণহীন উইকেটে রান-বন্যার এই টেস্টের ফল প্রথম দিন শেষেই নির্ধারিত। ড্র!হায়, দ্বিতীয় দিনে সেটিকে এখন কী ভুল চিন্তাই না মনে হচ্ছে! জয়ের গন্ধ পেয়ে শিকারির মতো চনমনে ক্যারিবীয় ক্যাম্প। আর হারের আশঙ্কায় ক্রমে কুঁকড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রহস্যময় উইকেট যে এর সব রহস্যময়তা নিয়ে আবির্ভূত হলো কাল। তাই ২৩.১ ওভারে হাওয়া ১০ উইকেট।


ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের শেষ ৫ উইকেট ১৪.২ ওভারে। এরপর মাত্র ৮.৫ ওভারে সাজঘরে ফিরেছেন স্বাগতিকদের প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যান। আরো আছে। দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশকে আনন্দে ভাসানো সব উইকেটই স্পিনারদের। আর ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলার ফিদেল এডওয়ার্ডসের আগুনের গোলায় ঝলসে গেছে টপ ও মিডল অর্ডারের প্রতিরোধ। উইকেট কি স্পিনসহায়ক নাকি পেসারদের সঙ্গে এর মিতালি। কী বলবেন?
আসলে চৌকো ওই ২২ গজের রহস্য ভেদ করা কারো জন্যই সহজ কম্ম না। মিরপুরের এ কৃষ্ণবর্ণের উইকেটের তো আরো নয়। কখনো তা পেসারদের বন্ধু, কখনো স্পিনারদের। কখনো-সখনো ব্যাটসম্যানদের দুই হাতে ভরিয়ে দিতেও এর কার্পণ্য থাকে না। টেস্টের বাকি তিন দিনে এর আচরণ যে কেমন হবে, সেটি জানতে পারলে নিশ্চয় বর্তে যেতেন মুশফিকুর রহিম ও ড্যারেন সামি।
তবে টুপটাপ উইকেট পতনের জন্য সব দায় উইকেটের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। দুই দিনই ক্রিজে সময় কাটানো কার্ক এডওয়ার্ডস তো বলে গেছেন, উইকেট প্রায় প্রথম দিনের মতোই ছিল। তার ওপর একতরফা বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি স্পিনার কিংবা পেসারদের দিকে। মূল ব্যাপারটা তাই নিহিত অন্যত্র। বোলারদের কৃতিত্ব এবং ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার যুগলবন্দি। ক্যারিবীয় লোয়ার অর্ডার ধসে পড়েছে স্বাগতিকদের ঘূর্ণিজাদুর সামনে। আর বাংলাদেশের টপ অর্ডার উড়ে গেছে এডওয়ার্ডসের গতিঝড়ে।
প্রথম দিনের ব্যাটিংবান্ধব চরিত্রের প্রতিফলন কাল সকালেও ছিল পুরোমাত্রায়। কার্ক এডওয়ার্ডস এবং মারলন স্যামুয়েলস খেলছিলেন স্বচ্ছন্দে। নাসির হোসেনের অবিশ্বাস্য এক রিটার্ন ক্যাচে পাল্টে যায় ম্যাচের রং। স্যামুয়েলসকে বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুঠোবন্দি করার পর খেই হারিয়ে ফেলে ক্যারিবীয় ইনিংস। শেষ চার ব্যাটসম্যান সাকিবের বাঁহাতি ঘূর্ণির শিকার। সাড়ে চার শ-পাঁচ শ'র সম্ভাবনা জাগানো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাই থেমে যেতে হয় ৩৫৫-তে।
ক্যারিবিয়ানদের না হয় লোয়ার অর্ডার উড়ে গেছে, বাংলাদেশের তো টপ অর্ডার ভেসে গেছে খড়কুটোর মতো। উইকেট যেমনই হোক, সত্যিকারের ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা যে কতটা অসহায়, সেটির আরেকটি প্রদর্শনী হলো কাল। পাঁজর বরাবর ধেয়ে আসা বলে খেলবেন না ছাড়বেন, রান করবেন না শরীর বাঁচাবেন_চিরন্তন এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আত্মহত্যার মিছিলে শামিল টপ অর্ডার। তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, শাহরিয়ার নাফীস, রকিবুল হাসান, মুশফিকুর রহিম_সবাই একই দোষে দুষ্ট। উইকেটে এমন কোনো জুজু না থাকার পরও শুধু ফাস্ট বোলিং জুজুতেই কুপোকাত সবাই।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আবহ হিসেবে একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল খুব। ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলারদের সঙ্গে বাংলাদেশি স্পিনারদের দ্বৈরথ। এত দিন পর্যন্ত নানা কারণে সেটির প্রতিফলন দেখা যায়নি। দেখা গেল কাল। ক্যারিবিয়ানরা যেমন স্পিনারদের বিপক্ষে নড়বড়ে, বাংলাদেশিরা তেমনি ফাস্ট বোলারদের। তবে ম্যাচের সময় যেহেতু গড়াচ্ছে, স্বভাবতই উপমহাদেশের উইকেট ঝুঁকে পড়বে স্পিনারদের দিকে। কাল দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে এটিকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাইলেন সোহরাওয়ার্দী শুভ, 'আজ দেবেন্দ্র বিশু যেমন বড় বড় টার্ন পাচ্ছিল, তাতেই বোঝা যায়, উইকেট ভাঙবে। ও বোলারদের রান আপের ক্ষত দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে। আমরাও যদি সেটি করতে পারি, তাহলে ভালো কিছুই হবে।' বিশু অত টার্ন পেলেও শুধু সাকিব ছাড়া অন্য কারো উইকেট পাননি। ভরসা তাই সেই ফাস্ট বোলারই। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফিদেল এডওয়ার্ডস। মাঠের ২২ গজ যেমনই হোক, ক্যালিপসো সুরের ঝঙ্কার তোলার জন্য তাতিয়ে আছেন তিনি।
আর যদি শেষ ইনিংসে উইকেট সত্যিই আনপ্লেয়েবল হয়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে বিশু তো থাকলেনই! নাহ্, ক্যারিবিয়ানদের দ্বিতীয় ইনিংস ঘূর্ণিজাদুতে যদি অল্প রানে গুটিয়ে দিতে না পারে বাংলাদেশ, তাহলে এই টেস্ট থেকে কিছু পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ড্র? প্রথম দিন শেষের সেই সম্ভাব্য ফলকে এখন তো মনে হচ্ছে হাস্যকর!

No comments

Powered by Blogger.