নারায়নগঞ্জের নির্বাচন, আমরা কেমনে খুশি হলাম by সরসিজ আলীম

ইভীকে নিয়ে নারায়নগঞ্জবাসীসহ সারাদেশ যেভাবে মেতে উঠলো, তাতে অবাকই লাগে। আইভীর বিজয়ে মনে হলো বিপ্লব জয়ী হয়েছে। পাবলিক বুঝলো না যে, শামীম ওসমানকে ক্ষমতাসীন দল বলির পাঠা বানালো আর আইভীকে পুতুল। সব জনপ্রতিনিধিই একটা শ্রেণির প্রতিনিধি। সেই প্রতিনিধিত্বে শামীমও যা, আইভীও তাই। একটা ব্যক্তি মানুষ শেষশেষ একটা বিশেষ শ্রেণির হয়ে যেতে বাধ্য। সার্বসাধারণ তার কাছে তখন প্রতিপক্ষ মনে হয়।

আমরা যাদেরকেই বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছি, তারা কখনই জনগণের পক্ষে থাকেনি। বিগত ও বর্তমান সরকার তার উদাহরণ। বোকা জনগণ কি এই দুই দলের সমান্তরালে দাঁড়াবার বিকল্প কোন পথ কি বের করতে পেরেছে? জনগণ কি সরকারের স্বার্থবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে? বিগত সরকারের দূর্ণীতিবাজদের কিছু করা গেছে, না যাবে? প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে সখ্যতা আমরা এড়াতে পারছি? বর্তমান সরকারের অপদার্থ মন্ত্রিদেরকে আমরা কিছু করতে পারছি? আমাদের খনিজ সম্পদ জনগণের সাথে প্রতারণা করে বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে সব সরকার, আমরা কি করতে পারলাম? করিডোর আমরা কি বুঝে পেলাম? ট্রানজিট দিয়ে আমরা যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখিন হলাম। আমাদের পণ্য ভারতের যে সব রাজ্যের বাজার পেতো, তাও তো হারালাম। গাড়ি চলাচলের জন্য যে অবকাঠামো, তার রক্ষণাবেক্ষণ, তার নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমান অর্থের এই গচ্চাটা আমরা নাগরিকরা কেনো দেবো? ভারতের সাথে আমাদের অসম সম্পর্ক। আর এই অন্যায্য সম্পর্ক কেনো রাখতে চাই? দেশটা দিন দিন ব্যাবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে, তাতে করে কি আমরা বুঝছি না যে, সরকার ব্যাবসায়ী ও ধনীক শ্রেণির স্বার্থের পক্ষের সরকার!

আমাদের কোন জাতীয়তাবাদী নেতা নেই। এখন আর আশা করারও নাই। সাদ্দাম আর গাদ্দাফির পরিণতি কেউ ররণ করতে চাইবে না। বঙ্গবন্ধু হয়তো জাতীয়তাবাদী নেতা হতে চেয়েছিলেন। আমাদের এক নেতাকে দেবতার আসনে বসাতে চেয়েছি, আবার কেউ তাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাই। এই প্রতিপক্ষ একজন বিশ্বাসঘাতককে মহামানবের আসনে বসাতে চাই। আমরা দু’পক্ষকেই বাহবা দিয়ে চলেছি। আর এইসব ভাস্কর্যকে কাঁধে নিয়ে ক্ষমতায় সওয়ার হচ্ছি। মাঝখান দিয়ে পয়দা হচ্ছে অপদার্থের দল আর চোর-লুটেরা। খুব দ্রুত টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এ সমাজটাকে উগ্র ভোগবাদীতার লালসার দংশনের ভেতর।

আমাদের শিক্ষা নিয়ে ব্যাবসা হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে ব্যাবসা চলছে। বেপেরোয়া হয়ে উঠছে টাকাঅলারা। তাদের কাছে সরকার, জনগণ অসহায়। সরকারের পেছন থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছে, তারা বিভিন্ন ফর্মূলা দিয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি বাবর ছিলেন একজন ক্ষমতাধরের হাতের পুতুল। তার পরিণতি আমরা দেখছি। এ সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু মন্ত্রিও একজন ক্ষমতাধরের পুতুল। তাই তার আকাশচুম্বি ব্যর্থতা সত্বেও আঁচলের তলে তারা বহাল তবিয়তে আছেন। সারারণ মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনী সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। আবার ন্যায়-বিচার প্রতিরোধ করার জন্য আছেন আমাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট।

আমরা কত অল্পতে খুশি হয়ে যাই। একটা পুতুলকে দম দিয়ে ভোটের বাজারে ছেড়ে দেয়া হলো। বলা হলো, এই তোমাদের ত্রাণকর্তা, তোমাদের নেতা। আমরা কত সহজে গ্রহন করলাম। তাকে জয়ী করলাম। আর ভাবলাম বিপ্লবে জয়ী হয়েছি। এই মানুষটা মুখোশ খুলে বের হতে বেশি সময় নেবে না। হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘরে ঘরে লুট করতে তেড়ে আসবে যখন, প্রতিরোধ করবে কোন সে নেতা? কোন সে শক্তি? আর দু/একদিনের মধ্যেই শেখ হাসিনার কাছে ফুল নিতে যাবেন তিনি। টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার পাতায় ভেসে উঠবে তার নায়িকার মতো মুখ। আহা! ভুল মানুষকে নেতা বানাবার দিন শেষ হবে কবে? ভুল পথে হেঁটে হেঁটে দিকভ্রষ্ট কেনো হচ্ছি বারবার? আমরা কেনো বুঝতে শিখবো না?

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিচর্চা বন্ধ করা হয়েছে। নতুন প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ। একজন রাজনীতিক আকাশ থেকে পড়বেন বলে আমরা আকাশের দিকে চেয়ে আছি। আমাদের অনেক প্রবীণ নেতার রাজনীতির মেয়াদ একেবারেই শেষের দিকে। নুতন রাজনীতিক কাদের পাচ্ছি আমরা? আমাদের ভবিষ্যত নেতারা কেউ চিকিৎসার নামে, আর কেউ পলিসি নির্মাণের নামে বিদেশে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখনই পাহাড় পরিমান দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আমাদের ভবিষ্যত কোথায়? আমাদের ভবিষ্যত ভূমিকস্পের মতো বড় বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছে না কি?

সরকার নারায়নগঞ্জের নির্বাচনকে মডেল হিসেবে বিরোধী দলের সামনে একটা দোয়ার খুলে দেখাতে চাইলো। সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়া, বর্তমান সরকারের আমলে দলীয় প্রার্থীর বাইরের কেউ জয়ী হতে পারে। এই সরকারকে তোমরা বিশ্বাস করতে পারো। এইটা দিয়ে জাতীয় নির্বাচন পার পাবার কোন আশা করার নেই।

আমি নিজেও তত্ববধায়ক সরকারকে মেনে নিই না। তত্ববধায়ক সরকার যুগের পর যুগ কার্যকর পদ্ধতি ভাবার কারণ নাই। নির্দলীয় কেউ থাকবেন না। নির্দলীয় ভূমিকা পালন করতে চাইলেও কেউ পারবেন না। ক্ষমতাসীল আর দলবাজরা সে ব্যবস্থা ভেঙে দেবেন। ইতিমধ্যেই তো ভেঙে দেয়া হয়েছে। তাহলে সেই ক্ষসতাসীনদের অধীনেই নির্বচনে ফিরে আসতে হবে। তাহলে সময়ক্ষেপন কেনো? দ্বি-দলীয় ধারার রাজনীতিতে দু’দলের বাইরে কেউ তো ক্ষমতা পাচ্ছে না। সমস্যা কি? বিরোধী দলের থাকতেও তো ক্ষমতার ভাগ কম জোটে না! তাহলে মানি না মানব না করে, কেনো বাবা জনগণের ঘাড়ে বাড়তি দূর্ভোগ চাপিয়ে দাও? ক্ষমতার পালাবদলে জনগণের কোন বিশেষ প্রাপ্তী নেই। কোন হেরেফের নেই।

আমরা কবে যে নতুন ভাবনা ভাবতে শিখবো? কবে যে বুঝতে শিখবো? কবে যে নিজেরা কিছু করতে শিখবো? কবে যে আমরা নিজেরা নেতা হবো?

লেখক পরিচিতি: সরসিজ আলীম।কবি। প্রতিমিডিয়া আন্দোলন গড়ে তুলতে পছন্দ করেন। বিভাগীয় সম্পাদক, চিলেকোঠা। ঢাকাতে বসবাস করেন। sorosijalim@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.