শিশুকন্যাকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় প্রতিশোধ!-এক শিশুকে হত্যা, আরেক শিশু ও মা গুরুতর আহত

প্রতিদিনের মতোই গতকাল দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফেরে শিশু সুস্মিতা (১২) ও সুমা (১০)। ঘরে ঢুকে তাদের ছোট দুই বোনকে নাম ধরে ডাকতে থাকে তারা। কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। রান্নাঘরে থাকা পাতিল শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে দুই বোন। পাতিলের কাছে গিয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে যায় দুজন। পাতিলে পানির মধ্যে পড়ে আছে ছোট বোন সুবর্ণার দেহ। চার বছরের সুবর্ণার জ্ঞান ছিল না। সুস্মিতা ও সুমা তখন 'মা' 'মা' বলে চিৎকার শুরু করে। আবারও থেমে যায় তারা। পাশেই মেঝেতে পড়ে আছেন তাদের মা রীনা। কপাল ও মুখমণ্ডল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েদের চিৎকার শুনে মা উঠে বসেন।


কিন্তু চেষ্টা করেও মেয়েদের কিছুই বলতে পারেন না তিনি। মা ও এক বোনের অবস্থা দেখে দুই বছরের ছোট বোন স্বর্ণাকে খুঁজতে থাকে সুস্মিতা ও সুমা। বোনদের 'স্বর্ণামণি' ডাক শুনে মায়ের মতোই

খাটের বিছানা থেকে মাথা উঁচু করে বসে স্বর্ণা। তার মুখ বেয়েও রক্ত পড়ছে বিছানায়।
ঘটনার এই বর্ণনা দিয়ে সুস্মিতা ও সুমা কালের কণ্ঠকে জানায়, এরপর তারা দিশেহারা হয়ে বিলাপ শুরু করে। তবে তাদের বিলাপ শুনে প্রতিবেশীরা কেউ দ্রুত সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনি।
জানা যায়, পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে মারা যায় সুবর্ণা রানী মৃধা। সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে স্বর্ণা রানী মৃধা (২) ও তাদের মা রীনা রানী মৃধা (৩৮)। গতকাল রবিবার বিকেলে অস্ত্রোপচারের পর মা রীনা জানিয়েছেন, মানিক কুমার দাস (২০) নামের এক আত্মীয়সহ দুজন তাঁর ও তাঁর শিশুদের ওপর এ নৃশংস হামলা চালায়। মেয়ে সুস্মিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে মানিককে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কারণেই এই নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয় সে। রানীর স্বামী ভবদেশ মৃধা জানান, বাসা থেকে ৭৫ হাজার টাকা লুট হয়েছে। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাটি ডাকাতি নাকি শত্রুতার জের, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল রাতে পুলিশ মানিককে আটক করেছে। থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছিল।
উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার ১৭ নম্বর লেনে বারেকের বাড়ির পেছনে লেকের পাড়ে নিজস্ব বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন ভবদেশ মৃধা। তিনি পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। ভবদেশের ভাগিনা তপন বালী ও তাঁর স্ত্রী শিপ্রা বালী জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুস্মিতা ও সুমার চিৎকার শুনে প্রতিবেশী লিপিসহ কয়েকজন ছুটে যান। তাঁরা আহতদের প্রথমে বাড্ডার উপশম হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ২টার দিকে চিকিৎসকরা সুবর্ণাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিকেলে মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয় রীনা রানী ও তাঁর মেয়ে স্বর্ণার। তারা এখনো আশঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক আবদুল হালিম জানান, রানীর মাথায় বড় ধরনের জখম আছে। নিহত সুবর্ণার মাথা ও হাতে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। পানির পাতিলে পড়ে ছিল সে। ছোট শিশু স্বর্ণার নাক ও মুখে জখম আছে। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
প্রতিবেশী বারেকের স্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বাচ্চাদের চিৎকার শুনেছি। তবে এত বড় ঘটনা বুঝি নাই। তাই ওই বাড়িতে যাইনি।' স্থানীয় লোকজন জানায়, বারেকের পরিবারের সঙ্গে ভবদেশের জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে।
জানা গেছে, ভবদেশের বড় দুই মেয়ে সুস্মিতা রানী মৃধা ও সুমা রানী মৃধা বনানী বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী। সুস্মিতা ষষ্ঠ ও সুমা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। গতকাল বিকেলে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা বারবার কেঁপে উঠছিল। দুজন জানায়, স্কুল ছুটির পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাসায় ফেরে তারা। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমে তারা একটি পানির পাতিলের মধ্যে সুবর্ণাকে পড়ে থাকতে দেখে।
ধারণা করা হচ্ছে, আঘাত করার পর সুবর্ণাকে পাতিলের পানিতে ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। স্বর্ণার নাকে ও মুখে আঘাত করার পর ফেলে রাখা হয় বিছানায়ই। তাদের মা রীনাকে একটি কুঠার দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। পাশেই রক্তমাখা কুঠারটি পড়ে ছিল। পুলিশ সেটি জব্দ করেছে। তাদের বাবা ভবদেশ বলেন, ঘরের কাঠের টেবিলের একটি ড্রয়ারে ৭৫ হাজার টাকা ছিল। সেটি ভাঙা, টাকা নেই। তবে স্বর্ণালংকার নেয়নি দুর্বৃত্তরা। আলমারি ও মালামাল তছনছ করলেও ঘর থেকে টেলিভিশনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়নি। সুস্মিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, 'ঘরে ঢুকে তিনজনকেই আমরা দেখি। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারেনি। আমরা কী করব, বুঝতাছিলাম না।'
গতকাল বিকেলে অস্ত্রোপচারের পর অস্ফুট স্বরে রীনা জানান, তাঁর বোনের ছেলে মানিকসহ দুজন বাসায় ঢুকে তাঁকে মারধর করে। তবে সন্তানদের মারধর ও হত্যার বিষয়টি তিনি জানেন না। ভবদেশ বলেন, তাঁর কাছে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। মানিক আগে তাঁর সঙ্গে কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। আত্মীয়তার সুবাদে তাঁর বাসায়ই থাকত। ছয় মাস আগে তাঁর বড় মেয়ে সুস্মিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় মানিক। শিশু মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাবে রেগে গিয়ে মানিককে বাসা থেকে বের করে দেন তাঁরা।
বাড্ডা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান জানান, ঘটনার পরই সন্দেহভাজন মানিককে আটক করতে অভিযান শুরু করা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে মেরুল বাড্ডা থেকে তাকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মানিকের সঙ্গে আরেক সহযোগী ছিল। বাসা থেকে টাকা লুট হওয়ার কারণে পূর্ববিরোধ এবং ডাকাতি দুটি বিষয়ই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.