ঝিকে মেরে বউকে শেখানো by আনিসুল হক

নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনের দিকে সারা বাংলাদেশের মানুষ পরম আগ্রহ ভরে তাকিয়েছিল। কারণ এটা আর নিছক একটা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে রইল না। এটা হয়ে দাঁড়াল শুভবাদের সঙ্গে পেশিশক্তির লড়াইয়ের একটা প্রতীকী মহড়া। দেশের মানুষ আশা আর আতঙ্কের সঙ্গে তাকিয়ে রইল,একাধিক মামলার আসামি জয়লাভ করেন, নাকি একজন মাটির মানুষ, একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ জয়লাভ করেন।

মানুষের প্রত্যাশা প্রথম হোঁচট খেলো, যখন মানুষ দেখল, দলের কাছে, ক্ষমতাধরের কাছে সুনীতি, মহত্ত্ব, সন্ত্রাস-বিরোধিতার কোনো দাম নেই। মানুষের উদ্বেগ সীমা ছাড়াল, যখন দেখা গেল, নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী চেয়েও পাচ্ছে না।
সব কৌতূহল, সব উদ্বেগের অবসান ঘটল। সত্যি কথা বলতে কি, যখনই দেখা গেছে, ঠিকঠাকভাবে ভোট হচ্ছে, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে, তখনই স্পষ্ট হয়ে গেছে কে জিততে যাচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের ভোটাররাও প্রত্যেকে দায়িত্ব মনে করে ভোটকেন্দ্রে
গেছেন এবং বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন তাঁদের প্রিয় সেলিনা হায়াত্ আইভীকে।
ঝিকে মেরে নারায়ণগঞ্জবাসী বউকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছে। তা হলো, কেন্দ্রের নেতাদের কথায় আমরা চলি না, আমি ভোটার, আমার একটা ভোট আছে, সেটা মূল্যবান, সেটা আমি দিই নিজের বিবেক-বিবেচনামতে, তুমি বললেই আমি তোমার হয়ে যাই না। আর বিরোধী দলের প্রার্থী যদি ভালো না হয়, তার আমলনামা যদি কালিমামুক্ত না হয়, তাঁকেও আমি প্রত্যাখ্যানই করি।
আমার নিজের ধারণা, তৈমুর তৃতীয়ই হতেন, যদি নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়াতেন, তবুও। গভীর রাতে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিএনপি একটা রাজনৈতিক চাল চেলেছে মাত্র। কারণ আইভীর বিজয় মানে সরকারি দলের পরাজয়। সে ক্ষেত্রে বিএনপি কারচুপি হয়েছেও বলতে পারত না। আবার নিজেদের তৃতীয় হওয়ার অপমানটাও তাদের হজম করতে হতো। এখন বরং তারা বলতে পারবে, এই নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও কার্যকর নয়। তারা সেনাদল চেয়েও পায়নি। কাজেই এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আমরা নির্বাচন করব না।
আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চাই, এই দাবি থেকে বিএনপি সরবে না। নির্বাচন কমিশনের চাওয়া সরকার পূরণ না করায় আইন ও সংবিধানের কতটুকু লঙ্ঘন হয়েছে, তা নিয়ে রিট হয়েছে, এই ব্যাপারটার একটা মীমাংসা হওয়া খুবই জরুরি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া এবং জনতার প্রার্থী সেলিনা হায়াত্ আইভীর বিজয়ের মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটতে যাচ্ছে না।
কিন্তু কয়েকটা বিষয়ে এই মুহূর্তে আমরা স্বস্তিবোধ করতে পারি।
এক. নির্বাচনটা সুষ্ঠু হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীর হয়ে জনতার রায় লুট করে নেবার কোনো রকমের চেষ্টা করা হয়নি। ভোটের ফল জনমতের প্রতিফলন হতে পেরেছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, কেউ আহত হয়নি, কোনো কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করে দিতে হয়নি। এ রকম কিছু ঘটলে তা হতো আগুনে ঘি ঢালা। মানুষের হতাশা বাড়ত, বিক্ষোভ সৃষ্টি হতো, বিরোধী দল আন্দোলনের রসদ পেয়ে যেত।
দুই. আবারও প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের শক্তির কাছে কোনো শক্তিই বড় নয়। আর মানুষ শুভর পক্ষে, শান্তির পক্ষে, আলোর পক্ষে। শুভবাদী মানুষের এই সমাবেশ যত বড়, তাদের কণ্ঠস্বর যত উঁচু হবে, তাদের শক্তি যত বাড়বে, বাংলাদেশ ততই আলোর দিকে, উন্নতির দিকে, শান্তির দিকে যাবে।
রাজনৈতিক দলের নেতারাও বিজয়ী হতে চান, বিজয়ীর সঙ্গে থাকতে চান। সন্ত্রাস করে, সন্ত্রাসী পুষে, দুর্নীতি করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে, ভূমিদস্যুতা করে, ভূমিদস্যুদের প্রশ্রয় দিয়ে জয়লাভ করা যায় না, এটা যদি রাজনীতিবিদেরা বুঝতে সক্ষম হন, তাঁরা
নিজেদের সে অনুযায়ী বদলাতে শুরু করবেন, অন্তত তাঁদের চারপাশ অন্ধকার করে রাখা খারাপ ভাবমূর্তির লোকদের কিছুটা দূরে সরিয়ে দেবেন, এটা আশা করা যায়। তবে ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, বোধকরি বধিরও করে, দেয়ালের লিখন তাঁরা পড়তে পারেন না, মানুষের আরতি তাঁদের কানে পৌঁছায় না। হয়তো এবারও পৌঁছাবে না। কিন্তু ভালোর পক্ষে আলোর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমাবেশকে বড় করার কাজটা আমাদের করে যেতেই হবে।
নারায়ণগঞ্জবাসী কেবল বউকে শিক্ষা দেয়নি, শুভবাদী মানুষকেও এই অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
অভিনন্দন নারায়ণগঞ্জবাসীকে।

No comments

Powered by Blogger.