জামায়াতের বেপরোয়া আক্রমণ by এ এম এম শওকত আলী

রাজপথে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বাংলাদেশে বিরল নয়। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা বারবার দৃশ্যমান ছিল। সমস্যা হলো, এর সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামাকারী কিছু মানুষও অংশ নেয়। পৃথিবীর বহু দেশেই কমবেশি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, অনুন্নত দেশেই এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বেশি।


এর মূল কারণ, রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব। অর্থাৎ যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ফল লাভ করেনি, সেসব দেশেই এমন বিষয় দৃশ্যমান। এ ধরনের ঘটনা তীব্র আকার ধারণ করলে দেশে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনার চরম ফল স্থায়ী হলে সে দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় বলে কিছু সমাজবিজ্ঞানী বলে থাকেন। বাংলাদেশ এ শ্রেণীভুক্ত নয়, যদিও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি সময় সময় দৃশ্যমান হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথের আন্দোলনে বিশ্বাসী। গত তিন দশকের ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, সাধারণত বিরোধী দলের এ বিষয়ে আগ্রহ বেশি। তবে রাজপথে আন্দোলনের সময় কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতাও আন্দোলনে অংশ নেয়। ভাঙচুরও করে। অগি্নসংযোগ করে। এদের মধ্যে কতজন রাজনৈতিক কর্মী এবং কতজন নিছক সুযোগসন্ধানী তা বোঝা দুষ্কর। তবে এ কথা ঠিক, আন্দোলনের আহ্বান রাজনৈতিক দল বা জোট দিয়ে থাকে। রাজপথে কর্তব্যরত পুলিশ আন্দোলনের কর্মীদের বাধা দিলেই হাঙ্গামা শুরু হয়। তাত্তি্বকভাবে অনেকে হয়তো বলবেন, শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা দেওয়ার অর্থ সংবিধান লঙ্ঘন করা। এর সঙ্গে জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নটিও জড়িত।
উপর্যুক্ত যুক্তি অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে এ কথাও সত্যি, সব ধরনের মৌলিক অধিকারের জন্য আইন রয়েছে। সংবিধানে বলা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যৌক্তিকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করতে ক্ষমতাবান। পুলিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যও একই ধরনের। তাদের মতে, জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই অননুমোদিত মিটিং-মিছিলে বাধা দেওয়া হয়। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও যোগ করা হয়। বলা হয়, মিটিং-মিছিল শান্তিভঙ্গের কারণও হতে পারে। এটা যে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সমাধান কী? এর একমাত্র সমাধান রাজনৈতিক নেতারাই দিতে পারবেন। দলগত শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের। তবে নানা কারণে বাস্তবে এটা সম্ভব হয় না। কারণ একাধিক। এক. কিছু উচ্ছৃঙ্খল মনোবৃত্তির মানুষও মিছিলে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি ভাঙচুর ও লুটপাটে আগ্রহী। তারা যখন এ কাজে লিপ্ত হয়, তখন কে রাজনৈতিক কর্মী আর কে নয়, তা বোঝা দুষ্কর। পুলিশকে আক্রমণ করলে পুলিশও তা বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিহত করে।
চরম আন্দোলনের অন্য নাম হরতাল। এ হাতিয়ার ব্যবহার করার প্রবণতা কমবেশি সব দলেরই আছে। এ হাতিয়ার ব্যবহার না করার জন্য অনেক কথাবার্তা অতীতে হয়েছে। তবে কোনো সমঝোতা হয়নি। সাম্প্রতিককালে হরতালের ব্যবহার অতীতের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে রাজনৈতিক আন্দোলন থামেনি। রাজপথে আন্দোলনের জন্য মহানগরী এলাকার মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। জেলার এ বিষয়টি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে থাকেন। তবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষের মতামত সাপেক্ষে এ অনুমতি দেওয়া হয়। যদি পুলিশ কর্তৃপক্ষের মতে, অনুমতি দেওয়া হলে জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে প্রতীয়মান, তাহলে অনুমতি দেওয়া হয় না। জনস্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে অনুমতির আবেদন অগ্রাহ্য করলে রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধাচরণ করে মিছিল বা পথসভা করে। তখনই দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। শুরু হয় যানবাহনের ক্ষতিসাধন ও দোকানপাট ভাঙচুর।
অনেক সময় কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করেই হঠাৎ মিছিল বের করা হয়। ৫ নভেম্বরের ঘটনাটি এর সাক্ষ্য বহন করে। এ আন্দোলনের মূল হোতা জামায়াত। সহযোগী সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। সহিংস মিছিল দেশের ১১টি জেলায় সংঘটিত হয়। অতীতে মিডিয়া এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনার জন্য জামায়াত গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিচার নস্যাৎ করার লক্ষ্যেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তবে মিডিয়ার সাবধানবাণীকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ঢাকাসহ ১১টি জেলায় ৫ নভেম্বর সহিংস ঘটনার ফলে পুলিশসহ প্রায় ২০০ ব্যক্তি আহত হয়েছে। ঢাকার মতিঝিল এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। ফলে প্রায় দুই ঘণ্টা জনজীবন পর্যুদস্ত ছিল। পুলিশের গাড়িসহ অন্য কিছু যানবাহনে অগি্নসংযোগ করা হয়। যে দাবি নিয়ে জামায়াত আন্দোলন করছে, তার পক্ষে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। তবু কেন এ আন্দোলন? মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত দুর্বল হয়ে গেছে। থেমে গেছে এ দলের সাংগঠনিক কর্মক্ষমতা। বাস্তবে দেখা যায়, তা হয়নি। জামায়াত এখনো রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ দলের উত্থান ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ দল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আরো জোরদার হয়।
৫ নভেম্বরের জামায়াতের তাণ্ডবলীলার পুনরাবৃত্তি ঘটে ঠিক পরদিনই। প্রথম দিনের ঘটনায় অনেক আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার ও জখম হওয়ার পর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ অন্য জেলায় কিভাবে এটা সম্ভব হলো, তা নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত। রাজশাহী ও সিলেটে এসব ঘটনার ভয়াবহ দৃশ্য মিডিয়ায় প্রতিফলিত হয়। এতে পুলিশসহ ৩০০ আন্দোলনকারী আহত হয়। একটি জেলায় অন্তত দুজন পুলিশের অস্ত্রও কেড়ে নিয়ে ভাঙচুর করা হয়। পরপর দুই দিন জামায়াতের এ ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থাপনায় যে অনেক দুর্বলতা রয়েছে, সে বিষয়টিরই সাক্ষ্য বহন করে। প্রথম দিনের ঘটনাটি পূর্বঘোষিত ছিল। এর পরদিনের ঘটনা হঠাৎ সংঘটিত হয়, যা অনুমান করা কঠিন ছিল না। ঘটনা দুটি ঘটার পরই এর গুরুত্ব সম্পর্কে সরকার সচেতন হয়। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, ঘটনার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি পুলিশের অন্যান্য সদস্যসহ রোমে ইন্টারপোলের সভায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের ঢাকায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন। জামায়াত পরিচালিত এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক। সরকারের উচ্চ মহল থেকে এ প্রসঙ্গে মন্তব্যও করা হয়েছে। তবে সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ ধরনের ঘটনা আবার যাতে না ঘটতে পারে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।
৮ নভেম্বর প্রকাশিত কালের কণ্ঠের সংবাদে দেখা যায়, জামায়াতের মারমুখী কর্মীদের দমন করার জন্য পুলিশের হাতে যথেষ্ট সরঞ্জাম ছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশ এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করেনি। বরং যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। পুলিশের কাছে হয়তো তথ্য ছিল যে জামায়াত লাশের রাজনীতি করতে আগ্রহী। এ কারণেই হয়তো পুলিশ এ ফাঁদে পা দেয়নি। অন্য একটি বাংলা দৈনিক একই বিষয় উল্লেখ করে আরো কিছু নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল মারমুখী আক্রমণের মাধ্যমে পুলিশের মনোবল দুর্বল করা। ঘটনা-পরবর্তী বিশ্লেষণে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এক. কর্তব্যরত কিছু পুলিশ কর্মকর্তার অদক্ষতা ও ভুল কর্মকৌশল। দুই. সরকারের শেষদিকে পুলিশের দোদুল্যমান দৃষ্টিভঙ্গি। এ পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কিছু পুলিশ কর্মকর্তার প্রতিক্রিয়া কিছুটা পরস্পরবিরোধী বলে প্রতীয়মান হয়। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত আইজির মতে, জামায়াতকর্মীদের আচমকা আক্রমণের জন্য পুলিশ প্রস্তুত ছিল না। অন্য কর্মকর্তারা যে মত ব্যক্ত করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। গোয়েন্দা সূত্রে পুলিশ আগে থেকেই জানত, পুলিশের ওপর আক্রমণ হবে। এ জন্য প্রস্তুতিও ছিল। এসব তথ্যের মধ্যে আরেকটি তথ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে, প্রেসক্লাব ও তৎসংলগ্ন এলাকায় জামায়াতের কর্মীরা সর্বাধিক সক্রিয়। কারণ এসব এলাকার বহু অফিসকর্মী জামায়াতপন্থী। অফিসের কাজ শেষে তারা সাংগঠনিক কর্মে লিপ্ত হয়। এ ধরনের মতবাদ ঢাকার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হলেও অন্য জেলায় একই ধরনের ঘটনার বিষয়টি কিভাবে হলো। এর কারণও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ঘটনাপ্রবাহে মনে হয়, জামায়াত আচমকা আক্রমণের কৌশল নিয়েছে। এ ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পূর্বাহ্নেই প্রস্তুতির প্রয়োজন। ৫ ও ৬ নভেম্বরের ঘটনা থেকে এ শিক্ষাই গ্রহণযোগ্য। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা আবার ঘটার অশঙ্কাই বেশি।

নভেম্বর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.