দুর্নীতি দমন কমিশন-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার নয়

দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নখ-দন্তহীন বানানো হচ্ছে বলে একসময় দুদক চেয়ারম্যানই মন্তব্য করেছিলেন। আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের আগে সরকারের পূর্ব-অনুমোদনের বিধান করার উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সব সচেতন মহল থেকেই এর বিরোধিতা করা হয়েছিল।


সন্দেহ করা হয়েছিল, দুদককে সরকার নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করতেই আইন পরিবর্তন করতে চায়। ওই উদ্যোগ সফল না হলেও হালে কিছু কার্যক্রম দেখে সেই সন্দেহ সত্য বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলোর ব্যাপারে সম্প্রতি দুদক যেভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে তাতে বোঝা যায়, সরকারের ইঙ্গিতেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান একসময় যে মন্তব্য করেছিলেন তা-ও যেন কার্যকর হতে শুরু করেছে। বিরোধী দল দাবি করছে, দুর্নীতি দমনের নামে তাদের নেতাদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে দুদককে ব্যবহার করছে সরকার। দুর্নীতি দমনের নামে কার্যত বিএনপি দমন করা হচ্ছে। সরকারকে মনে রাখা উচিত, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। দুদককে এভাবে ব্যবহার করা অনুচিত এবং অনৈতিক হবে। দীর্ঘকালের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত দুদককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যাতে ব্যবহার না করা হয়, সেই প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু সরকার এ প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করার সব চেষ্টাই অব্যাহত রেখেছে। দুদক আইনে প্রদত্ত স্বাধীনতা হারিয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে। বর্তমান সরকারি দল নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল স্বাধীন দুদক প্রতিষ্ঠার আইনগত উদ্যোগ গ্রহণের; কিন্তু কার্যত এর বিপরীত কাজই হয়েছে তাদের হাত দিয়ে।
দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনগত সুবিধা দেওয়া থেকে বিরত থাকাই শুধু নয়, তার নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে জনশক্তি ও অবকাঠামোগত সুযোগ প্রয়োজন, তা-ও দেওয়া হয়নি। দুদককে দুর্বল করে রাখার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে করা হচ্ছে, তার সত্যতা মেলে এসব পদক্ষেপ থেকেও।
যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারের একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ভিন্ন মতাবলম্বীদের মত প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া এবং রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে সরকার সেই পথ থেকে সরে এসেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
রাজনৈতিক কারণে কারো বিরুদ্ধে মামলা হলে সেই মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে শাসক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতার ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহারও করা হয়েছে। বিশেষ করে গত চারদলীয় জোট সরকার আমল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রুজু করা হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহারও করা হয়েছে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সেগুলো দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেই হৈচৈ হচ্ছে ব্যাপক। আবার সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা যে কারণে অব্যাহতি পাচ্ছেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও যদি তাঁদের সমান সুবিধা পেতেন, তাহলেও এ বিতর্ক তৈরি হতো না। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে দ্বিমুখী। সুবিধার ক্ষেত্র থাকছে নিজেদের পাল্লায়, আর বিরোধী দলের নেতাদের দেওয়া হচ্ছে দুর্ভোগের পাল্লা। সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আগের আমলে রুজু করা মামলাগুলোর মধ্যে খুনের অভিযোগ থেকে শুরু করে লুটপাটের মামলাও রয়েছে। সংগত কারণেই আওয়ামী লীগ-বহির্ভূর্ত অন্য দলগুলোও একই সুবিধা পাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, দুর্নীতি দমনের জন্য গত চারদলীয় জোট আমলে দুদক গঠনের প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতার অভাব, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। এই সরকার এসে তাকে সেই অপবাদ থেকে উদ্ধার করা দূরে থাক, একে অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এ কারণে আজকে দুদককে সরকার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে তাই রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রয়োজন, যা দেশবাসী দেখতে চায়।

No comments

Powered by Blogger.