মানসম্মত শিশুশিক্ষা by মোঃ মুজিবুর রহমান

দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, শিশুদের পড়ালেখা করানোর জন্য সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলেও এদের অধিকাংশেরই মানসম্মতভাবে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া পরিচালনা করার প্রয়োজনীয় উপযুক্ততা ও দক্ষতা নেই।


বিশেষ করে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বহু স্কুল শুধু যেনতেনভাবে পাঠদান পরিচালনা করে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয় না।
প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেনগুলোর পাঠদান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই উপযুক্ত শিখন-শেখানো পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ ও অনুশীলন করা হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠন প্রক্রিয়ায় শিশু মনস্তত্ত্বের প্রয়োগ থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। সারাদেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে স্থাপিত অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে শিখনবান্ধব পরিবেশের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব, অপ্রশস্ত শ্রেণীকক্ষ, ভাড়া করা জায়গায় স্কুল স্থাপন ইত্যাদি সমস্যার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার বেশিরভাগ সরকারি প্রচেষ্টায় পরিচালিত হলেও প্রায় সব প্রাথমিক স্কুলেও বিরাজ করছে নানা ধরনের সমস্যা। এসব সমস্যার মধ্যে শিক্ষক সংকট, শিক্ষা সহায়ক উপকরণের অভাব, শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুলগুলোর অনাকর্ষণীয় পরিবেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি রীতিমতো উপেক্ষিত। শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি উদ্বেগজনক তা হলো, সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম সরকারের তরফ থেকে মাঝে মধ্যে পর্যবেক্ষণ করা হলেও কিন্ডারগার্টেনগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া আমাদের চোখে পড়ে না। শুধু তাই নয়, কিন্ডারগার্টেনগুলো কোনোরূপ সরকারি অনুমোদন ব্যতীত অনেক ক্ষেত্রে শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ওপর নির্ভর করে বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বজায় রাখার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রসারতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের কাজটি সচরাচর মৌখিকভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে। অধিকাংশ শিক্ষকের নেই কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ। ফলে শিক্ষকরা দায়িত্বের সঙ্গে পদ্ধতিসম্মতভাবে পাঠদান করতে পারছেন না। কাজেই এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো, সরকারি পর্যবেক্ষণের আওতাবহির্ভূত অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান এবং প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের মাধ্যমে আমরা কিছুতেই শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা আশা করতে পারি না।
পাঠ্যবই ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসা দরকার তা হলো, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সরকারিভাবে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হলেও কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে অপ্রয়োজনীয় বইয়ের ছড়াছড়ি দেখা যায়। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইগুলো সরকার কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়ায় বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কাজেই কিন্ডারগার্টেনে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানে চালু বইগুলোর যথাযথ মান নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝাও হ্রাস করতে হবে।
আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের লক্ষ্যে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি শিশুশিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর শিক্ষকরা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতা শ্রেণীকক্ষে প্রয়োগ করছেন কি-না তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া যারা স্কুলশিক্ষকদের শ্রেণী পাঠদান পর্যবেক্ষণ করবেন তাদের উপযুক্ততাও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা স্কুলে পাঠদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারীদের যদি নিজেদের পেশাগত প্রশিক্ষণ না থাকে তাহলে এরূপ ব্যক্তিদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে বলে ধারণা করা যায়।
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাবনা
 

No comments

Powered by Blogger.