ভর্তিতে এবারও বাড়তি ফি নেবে রাজধানীর স্কুলগুলো by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

সরকারকে 'বুড়ো আঙুল' দেখিয়ে দুই বছর ধরে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ভর্তিতে গলাকাটা ফি নিচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তিতেও বেশি টাকা নেওয়ার 'ঐতিহ্য' অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ ভর্তির জন্য সরকার নীতিমালা করে দিয়েছিল। সেই নীতিমালার ধারেকাছেও ছিল না তারা। এ অবস্থায় আজ রবিবার সকাল ১১টায় আগামী বছরের ভর্তির নীতিমালা চূড়ান্ত করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।


কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা বলেছেন, সব কিছুর খরচ বাড়ার কারণে ভর্তির ফরম ও ভর্তি ফি সরকারকে বাড়াতে হবে। সরকার যদি গত বছরের চেয়ে এ দুই খাতে টাকার পরিমাণ বাড়ায় তবেই সরকারের নীতিমালা তাঁরা মানতে রাজি। তাঁরা বলেন, বেশি টাকা নিয়ে কারো ব্যক্তিগত উন্নয়ন হয় না, প্রতিষ্ঠানেরই উন্নয়ন হয়। এ কথাটা সরকারকে বুঝতে হবে।
ভর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অতিরিক্ত ফি নেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো চাপ না থাকায় প্রতি বছরই প্রতিষ্ঠানগুলো এমন কাজ করছে। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজই বারবার ভর্তিতে বেশি টাকা নিচ্ছে। আর এ তিন বড় প্রতিষ্ঠানের কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠাগুলোও বেশি টাকা নেওয়া শুরু করেছে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি বছর ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার জন্য ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদন্ত হয়। এর মধ্যে ২৪টি প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা নিয়েছে বলে কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে তিন দফা চিঠি দিয়ে বেশি টাকা ফেরত কিংবা শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয়কে পাত্তাই দিচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যারা গত দুই বছর ভর্তির নীতিমালা না মেনে কাজ করছে, তারা কিভাবে এবারের নীতিমালা মানবে?
শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেছেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য কত ফি হওয়া উচিত তা সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি জানান, চলতি বছর যেসব প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা নিয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করেছে।
সচিবের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে অভিভাবক ফোরামের এক নেতা বলেন, গত এক বছরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, মন্ত্রণালয় চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কথায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল গত বছর ভর্তির ফরম বিক্রি করেছে ৬০০ টাকায়। অথচ সরকার বেঁধে দিয়েছিল ১০০ টাকা। আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরমের জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সুপারিশ করেছে ২০০ টাকা। কিন্তু এ নির্দেশ প্রতিষ্ঠানটি মানবে কি না তা এখন স্পষ্ট করেনি। এ ছাড়া চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটির মুগদা শাখা সাধারণ শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন ফি হিসেবে দুই লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা ও মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৩১ হাজার ৯০০ টাকা নিয়েছে। মতিঝিল শাখা ইংরেজি ভার্সনে ১৭ হাজার ৯০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যমে ১১ হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। এ ছাড়া গত ১১ মার্চ এ প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এ ভর্তির ক্ষেত্রে মুগদা শাখায় নেওয়া হয় ইংলিশ ভার্সনে ২০ হাজার ৪৫০ এবং বাংলা মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা। মতিঝিল মূল শাখায় বাংলা মাধ্যমে নেওয়া হয় ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী বাড়তি টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারের নীতিমালা মানতে চাই। এ ক্ষেত্রে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ভর্তি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক খরচ হয়। এ টাকা ভর্তি ফরম বিক্রি করেই তুলতে হয়। ১০০ আর ২০০ টাকায় এ খরচ সংকুলান হয় না।' বেশি টাকা ফেরত না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কেন টাকা ফেরত দিইনি তা কয়েক দফায় সরকারকে ব্যাখ্যা দিয়েছি।'
ভিকারুননিসা নূন স্কুলে চলতি বছর ভর্তি ফরম বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকায়। গত বছর ভর্তিতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলা মাধ্যমে নিয়েছে ১২ হাজার ৭০০ এবং ইংলিশ ভার্সনে নিয়েছে ১৪ হাজার ১০০ টাকা। আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। চলতি বছর সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা নেওয়ার বিধান দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ মঞ্জুয়ারা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভর্তি ফরমের দাম ২০০ টাকা রাখার সুপারিশ করা হয়। আজকের বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কথা শুনে তাঁদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে ফরমের দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। একইভাবে মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ গত দুই বছর ভর্তিতে বেশি টাকা নিয়েছে। কিন্তু সরকারের নির্দেশমতো বেশি টাকা ফেরত কিংবা সমন্বয় করেনি প্রতিষ্ঠানটি। অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, 'আমরা সরকারের নীতিমালা মানার পক্ষে।' নীতিমালা মানার পক্ষে বললেও বাস্তবে তার উল্টো হয় কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় আজ বৈঠক ডেকেছে, বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিস্তারিত বলব।

No comments

Powered by Blogger.