রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে নিয়োগ ও বিচারিক এখতিয়ার by এ এম এম শওকত আলী

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের। বিচার বা নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিষয়ে সংবিধানসম্মত আইন ও বিধি রয়েছে। উচ্চতর আদালতে নিয়োগের বিষয়েও সংবিধানে অনুসরণীয় পদ্ধতি বলা আছে। বিচার বিভাগ একটি রাষ্ট্রীয় স্বাধীন অঙ্গ। তবে এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নয়।


স্বাধীনতার বিষয়টি বিচারিক কার্যসম্পাদনের সঙ্গেই যুক্ত। এ বিষয়ে সংবিধানের ধারা স্পষ্ট। স্বাধীনতার বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে যে_সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। অন্য কোনো ক্ষেত্রে এ স্বাধীনতা প্রযোজ্য নয়। এ ছাড়া বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠিও সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। একই সঙ্গে বলা আছে যে উচ্চতর আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য যোগ্যতা না থাকলে কোনো ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
এ ধরনের সাংবিধানিক বিধানের মাধ্যমে মূলত সংসদ এবং পরোক্ষভাবে নির্বাহী বিভাগকে এ বিষয়ে কিছু দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। কারণ, সংসদে আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগই প্রাথমিকভাবে কিছু দায়িত্ব পালন করে। আইনের প্রস্তাব খসড়া আকারে মন্ত্রিসভায় আলোচনার পর বিল আকারে অনুমোদিত খসড়া সংসদে পেশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলটি সংসদে পেশ করে। এরপর শুরু হয় বিলের ওপর মতামত গ্রহণ-প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে কণ্ঠভোটে বিলটি গৃহীত হলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আইন হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং গেজেট প্রকাশিত হয়।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে যে ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সংবিধানে আইন করার বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও কোনো আইনই এ বিষয়ে করা হয়নি। অতিসম্প্রতি হাইকোর্টের রায়ের ফলে সরকার এখন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইনবিহীন সময়ে যাঁরা সুপ্রিম কোর্টে বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন বা এখনো করছেন, তা সংবিধানসম্মত হয়েছে কি না। এ প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক হলেও হবে নিতান্তই একাডেমিক ধরনের। কারণ, বিচারক হিসেবে যোগ্যতার মূল মাপকাঠি সংবিধানেই বলা হয়েছে। এত দিন যাঁরা বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন, তাঁদের অযোগ্যতার প্রশ্ন দু-একটি ক্ষেত্রে উত্থাপিত হলেও তা বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানের পরই হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে সংবিধানে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও রয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধান বিচারপতিসহ কয়েকজন বিচারপতির আপিল বিভাগে নিয়োগের বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। এর মূল কারণ, জ্যেষ্ঠত্বের মাপকাঠি অনুসৃত না হওয়ায় কিছু জ্যেষ্ঠ বিচারক অতিক্রান্ত (ঝঁঢ়বৎংবংংরড়হ) হয়েছেন।
বিচারপতি নিয়োগের আইন প্রণয়ন না হওয়ার মতো আরো একটি উদাহরণ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়েও উত্থাপন করা সম্ভব। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়েও সংবিধান অনুযায়ী এ আইন প্রণয়ন বাধ্যতামূলক। তবে সংবিধানে এ কথাও বলা আছে যে আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রপতি বিধি প্রণয়ন করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এ আইন প্রণয়ন করা হয়নি। তবে সাম্প্রতিককালে জানা গেছে যে নির্বাহী বিভাগ এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে। কিছুদিন আগে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বক্তব্যে শোনা গিয়েছিল যে গত বছর মে মাসের মধ্যেই এ-সংক্রান্ত বিল সংসদে আলোচনা করে পাস করা হবে। সেটা এখনো হয়নি। আশা করা যায়, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
সংশ্লিষ্ট আইনের ধারাগুলো সম্পর্কে এখনো অনেকেই অবগত নন। তবে ধারণা করা যায় যে প্রস্তাবিত আইনে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের চাকরি-সংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধানের কিছু বিধান থাকবে। যেমন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই শুরু হয় কোন কর্মকর্তা কোন দলের সমর্থক বা কোন দলের প্রতি অনুগত_এ বিষয়ে অনুসন্ধান। এর কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠিও নেই। শুরু হয় জনসমক্ষে রাষ্ট্রবিরোধী বা বিশ্বাসঘাতক বা ওই ধরনের কিছু বলে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তাকে অযোগ্য চিহ্নিত করার রাজনৈতিক অনুসন্ধান (ডরঃপয-যঁহঃ)। এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যেকোনো ব্যক্তির সরকারি চাকরিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর যদি তাঁকে কমিশন নিয়োগের সুপারিশ করে, তাহলে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে পুলিশি অনুসন্ধান হয় এবং এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এমনকি কারাবাস করেছেন এমন কিছু ব্যক্তিও পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন পাকিস্তানের উচ্চতম সার্ভিসে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে এর সম্পূর্ণ বিপরীত মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে কিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার পর পরবর্তী ক্ষমতাসীন দল তা বাতিল ঘোষণা করে। অর্থাৎ নিয়োজিত কর্মকর্তারা চাকরিচ্যুত হন। এ ধরনের অশুভ ধারা প্রতিহত করার জন্য বিচার বিভাগও এগিয়ে আসে। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের আদেশবলে তাঁরা আবার নিয়োগ লাভ করেন। প্রস্তাবিত সিভিল সার্ভিস আইনে এ ক্ষেত্রে কী ধরনের নিরাপত্তাবিষয়ক বিধান দেওয়া হবে, তা এখনো জানা নেই। তবে এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে এ বিষয়েও কিছু বিধান থাকা নিঃসন্দেহে আবশ্যক।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই হয়। এর কোনো ব্যত্যয় সাধারণত করা হয় না, যদি না প্রার্থীর চরিত্র অনুসন্ধানে পুলিশের কোনো নেতিবাচক প্রতিবেদন থাকে। এ বিষয়টিও অনেকাংশে অস্পষ্ট। আলোচ্য আইনে এর স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে অধ্যয়নরত অবস্থায় কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা রয়েছে কি না, এখানে শুধু প্রাথমিক তদন্ত বিবরণী (এফআইআর) থাকলে নিয়োগ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চিন্তাভাবনা করে গ্রহণ করতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক প্রভাবেও এফআইআর হতে পারে। চার্জশিট না হলে প্রার্থী নিয়োগ দানে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। আর যদি সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়, তাহলে নিয়োগ প্রদান করা সঠিক হবে না। খসড়ায় এ বিষয়ে স্পষ্ট বিধান থাকা সংগত হবে।
চার্জশিটের বিষয়ে সাম্প্রতিককালে ভারতের চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনার পি জে টমাসের মামলাটি প্রাসঙ্গিক। টমাস ভারতের চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনার। এ কমিশনটি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুরূপ। গত বছর সেপ্টেম্বরে টমাস চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এর আগে তিনি কেরালায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ওই সময় পাম তেল আমদানি-সংক্রান্ত এক দুর্নীতি মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি হিসেবে চিহ্নিত হন। এ সত্ত্বেও তাঁকে কেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো_সে প্রশ্নটিই ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে আনে।
ভারতের সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (সিপিআইএল) অর্থাৎ জনস্বার্থবিষয়ক মামলা-সংক্রান্ত একটি নাগরিক প্রতিষ্ঠান টমাসের নিয়োগ বাতিলের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। আদালত টমাসকে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দেন। কারণ দর্শানোর প্রক্রিয়ায় টমাস যুক্তি প্রদর্শন করেন যে চার্জশিট হওয়ার কারণে তাঁর নিয়োগ ত্রুটিপূর্ণ নয়। এমনকি টমাস আরো শক্ত যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, চিফ ভিজিল্যান্স কমিশনারের নিয়োগের যথার্থতা পর্যালোচনা করার কোনো ক্ষমতা আদালতের নেই। এর সঙ্গে আরো একটি যুক্তি যোগ করে বলেন, এমপি-এমএলএরা সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও স্বীয় পদে আসীন রয়েছেন। কারণ, তাঁরা আপিল করেছেন। একটি ভারতীয় পত্রিকা প্রধান বিচারপতির এ বিষয়ে পাল্টা মত প্রকাশ করেছে। তাঁর মতে, যদি সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে বলা যাবে না যে বিচারিক পর্যালোচনার এখতিয়ার আদালতের নেই। তিনি আরো বলেন, বিচারিক পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা সংবিধানের সংশোধনীও বাতিল করার ক্ষমতা রাখি।
শুনানির একসময়ে টমাসের কেঁৗসুলি আদালতকে বলেন, রাষ্ট্রীয় যেকোনো পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করবে সংসদ। আদালত যদি এ প্রশ্ন এখন নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় বহু পদের বিষয়েই তা করতে হবে। এ পর্যায়ে কেঁৗসুলির আরো মন্তব্য ছিল যে যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মাপকাঠি সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা নির্ধারিত। এ ক্ষেত্রে আদালত যদি যোগ্যতা ও অযোগ্যতার মাপকাঠি পর্যালোচনা করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট আইনেই এসব বিষয় যোগ করতে হবে। যে বিষয়টি বলা হয়নি তা হলো, সংসদ এ বিষয়ে সম্মতি না দিলে আইনে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। এ সময় আদালত বলেন যে এ ধরনের বহু ক্ষেত্রে আদালত এর আগে রায় দিয়েছেন যে সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই না করে কোনো নিয়োগ প্রদান করা হলে তা আইনসিদ্ধ হবে না। মামলার রায়ে শেষ পর্যন্ত কী আদেশ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে যে প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে তা প্রাসঙ্গিক।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি মূল, তা হলো টমাস এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নন। এ ছাড়া টমাসের কেঁৗসুলি যুক্তি প্রদান করেন যে কমিশনের আইনে এ বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ বিধান নেই। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি শেষ পর্যন্ত উক্তি করেন যে এ মামলাটিই বিচারের বিষয় নয়। আদালত ভবিষ্যতে এসব পদে নিয়োগের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করবেন। বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় কী? বিচারপতি নিয়োগের যে খসড়া এখন প্রণয়ন করা হচ্ছে, সে আইনে কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্রসহ ফৌজদারি মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে বিধান রাখা সমীচীন হবে। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রার্থীর ব্যক্তিগত সততা ও সুনাম সন্দেহাতীত রাখাই বাঞ্ছনীয়। এরপর বলা যায় যে বিচারক হিসেবে তিনি বিচক্ষণতাসহ নিয়মানুবর্তিতার সাক্ষ্য রেখেছেন কি না। এসব বিষয় সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা নেই। ধরে নেওয়া হয়েছে, সব বিচারকই বিচক্ষণ এবং সঠিক সময়ে আদালতে হাজির হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। পত্রিকান্তরে এমনো অভিযোগ করা হয়েছে যে রায় লিখতে অনেক বিলম্ব হয়। এ বিষয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কয়েক বছর আগে ভারতীয় সংবিধান কমিশন কিছু সুপারিশ করেছিল। বাংলাদেশের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই প্রতিবেদন পরীক্ষা করে কিছু বিধান অবশ্যই প্রস্তাবিত আইনে যুক্ত করতে পারে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.