বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৬৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ আবদুল মতিন, বীর প্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সাহসী এক যোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে সিলেটমুখী সড়কের ১৮ মাইল পরই মাধবপুর। হবিগঞ্জ জেলার (১৯৭১ সালে মহকুমা) অন্তর্গত।


মুক্তিযুদ্ধকালে ২৮ এপ্রিল এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ আবদুল মতিন।
মাধবপুর এলাকাকে তিতাস নদী ও এর শাখা সোনাই নদী দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এর পূর্ব পাশে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন হলে মেজর কে এম সফিউল্লাহর (পরে মেজর জেনারেল ও প্রথম সেনাপ্রধান) নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হন মাধবপুরে। তাঁর দলে ছিলেন আবদুল মতিন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২১ এপ্রিল শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। জঙ্গি বিমানের অব্যাহত আক্রমণ এবং অবিরাম কামানের গোলাবর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা নদীর তীর ধরে শাহবাজপুরে চলে আসে। সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল মতিন। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন।
রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শাহবাজপুর দখল করে। তবে মোহাম্মদ আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের যথেষ্ট দেরি করিয়ে দিতে সক্ষম হন। তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতিও করেন।
আবদুল মতিন যখন বুঝতে পারেন যে তাঁদের পক্ষে আর প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়, তখন তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চাদপসরণ করেন। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি প্রথমে জগদীশপুর-ইটখোলা সড়কে নতুন করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। পরে তাঁরা কৈতরা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
২৮ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আবদুল মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। তারা নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করছিল। প্রাথমিক আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রগামী দল দুপুর ১২টার মধ্যে মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সব প্রতিরক্ষার সামনে পৌঁছে যায়।
প্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সেনা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। বাঁ পাশের দল মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দক্ষিণ ভাগের অবস্থান অর্থাৎ মোহাম্মদ আবদুল মতিনের প্রতিরক্ষায় আক্রমণ করে। দ্বিতীয় দল মুক্তিবাহিনীর দুই প্রতিরক্ষার মাঝ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তৃতীয় দল মুক্তিবাহিনীর অপর প্রতিরক্ষায় আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাপ্রধান)।
পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি ব্যাটালিয়ন এসে যুদ্ধে যোগ দেয়। বিকেল চারটা পর্যন্ত দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। সংকটময় এমন মুহূর্তে মোহাম্মদ আবদুল মতিন বিচলিত হননি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি আক্রমণের যথোপযুক্ত জবাব দেন। এই যুদ্ধে তিনি অপরিসীম সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন।
মোহাম্মদ আবদুল মতিন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে পৈতৃক বাড়িতে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ময়মনসিংহে সমবেত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে ৩ নম্বর সেক্টরের সিমনা সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘এস’ ফোর্সের অধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো (বি) কোম্পানির অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ আবদুল মতিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৩।
মোহাম্মদ আবদুল মতিন স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ২০০৮-০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন চট্টগ্রাম মহানগরে (ফ্ল্যাট-সি৩, বাড়ি-১০০, সড়ক-৪, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা)। তাঁর বাবার নাম আবদুল গনি, মা রওশন আরা বেগম। স্ত্রী শওকত আরা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.