একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ-ওদের বিচারের রায় বিজয়ের মাসেই by বদি-উজ-জামান

একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করা, ধর্মান্তরিত-করণসহ মানবতা-বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বর্তমান নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ দলটির চার নেতার বিচারকাজ ডিসেম্বরে শেষ হতে পারে। অন্য দুজন হলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১৩টি মামলার বিচার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের (প্রসিকিউটর) সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ ১৩ ব্যক্তি এখন দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি। এ দুটি ট্রাইব্যুনালে এখনো কারো বিচার শেষ হয়নি। তবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চারজনের বিচারকাজ শেষ হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু কালের কণ্ঠকে জানান, এ নিয়ে অতীতে অনেক কথা হয়েছে। তাই কতজনের বিচার এ বছর শেষ হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা ঠিক হবে না। তবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারকাজ শেষ হওয়ার পথে।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার একজন প্রসিকিউটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, কার বিচার কবে শেষ হবে, সে বিষয়ে প্রসিকিউশনের কারো প্রকাশ্যে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে মামলার অগ্রগতি থেকে আশা করা যায়, ডিসেম্বরের মধ্যে চারটি মামলার রায় হতে পারে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বিভিন্ন বাহিনী ও গোষ্ঠীর স্থানীয় যেসব সদস্য গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার করার জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
দুটি ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সর্বপ্রথম বিচারকাজ শুরু হয় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। গত বছর ১৪ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। একই বছরের ৩ অক্টোবর ২০টি অভিযোগে অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৫ জন। তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি নেওয়া এবং তাঁকে জেরা করতেই ৫৯ কার্যদিবস লেগেছে। বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালে এ বিচারকাজ চলছে। বাংলাদেশে প্রথম এ ধরনের বিচারকাজ চালাতে শুরুর দিকে বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। ট্রাইব্যুনালের নিজস্ব বিধি করতে হয়। কয়েকবার বিধি সংশোধন ও সংযোজন করা হয়। দেশীয় আইনে বিচার করতে গিয়ে আসামিপক্ষের অনেক আবেদন নিষ্পত্তি করতে হয়েছে ট্রাইব্যুনালকে। ফলে অনেক সময় চলে গেছে। এ কারণে সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় তুলনামূলক বেশি সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত এ মামলায় ৫ নভেম্বর থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হবে। যেভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে এ মাসেই তা শেষ হতে পারে। সেক্ষেত্রে এর কয়েক দিন পরই ঘোষণা করা হতে পারে রায়। এটা ১৬ ডিসেম্বরের আগেই হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশা।
একই ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। আজ ১১ নভেম্বর আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য শুরুর দিন ধার্য রয়েছে। গোলাম আযমের পক্ষে ১২ জন সাফাই সাক্ষ্য দিতে পারবেন। তাঁর পক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে দুই হাজার ৯৩৯ জনের তালিকা জমা দেওয়া হয়েছিল। সাফাই সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। এরপর রায়। ডিসেম্বরেই রায় ঘোষণা হতে পারে বলে প্রসিকিউশনের আশা।
এ ছাড়া বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের নেতৃত্বাধীন ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। ১১ নভেম্বর আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। আসামিপক্ষ সাফাই সাক্ষী হিসেবে ৯৬৫ জনের তালিকা দিলেও ট্রাইব্যুনাল ছয়জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাফাই সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ডিসেম্বরের মধ্যেই রায় হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী।
একই ট্রাইব্যুনালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষ আর মাত্র দুজন সাক্ষী হাজির করতে পারে। এরপর সাফাই সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। এ বিষয়ে এ মামলায় প্রসিকিউটর নুরজাহান মুক্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে এ মামলার বিচারকাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যদি আরো বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে তবে তাতে আমাদের আপত্তি নেই।'
সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় বিচারকাজের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য মামলায় বিচারকাজে তুলনামূলক অনেক কম সময় লাগছে। সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রথম বিচার শুরু হওয়ায় সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লেগেছে সব পক্ষের। এ মামলার অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রপক্ষ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হাজির করছে কম। ফলে দ্রুত সাক্ষ্য শেষ হচ্ছে। এ ছাড়া আসামিপক্ষ কতটুকু সময় জেরা করতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন ট্রাইব্যুনাল।

No comments

Powered by Blogger.