আ. লীগে গিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না মোবারকের by ওমর ফারুক

ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েও পার পাচ্ছেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোবারক হোসেন। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সংস্থার সদস্য কয়েক মাস আগেও এলাকায় গিয়ে তদন্ত করে এসেছেন।


অচিরেই আবার যাবেন। মোবারক হোসেন কয়েক মাস আগেও আখাউড়া উপজেলার মোগরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, তদন্তে নেমে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, মোবারক হোসেন একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুরে আবদুল খালেক নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম ২০০৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১১ মাস কারাগারে ছিলেন মোবারক।
বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। এ অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরিও করা হয়েছে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মোবারক হোসেন রাজাকার কমান্ডার হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি জামায়াতের রুকন (সদস্য) ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জামায়াত ছেড়ে ওই দলে যোগ দেন তিনি। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার ঘটনায় কারাগারে থাকা এবং ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত শুরু করায় মোবারক হোসেন কয়েক মাস আগে গঠিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে ঠাঁই পাননি।
মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত করছেন তদন্ত সংস্থার সদস্য শ্যামল চৌধুরী। তদন্ত কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাঁর (মোবারক হোসেন) বিরুদ্ধে তদন্ত করে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছি আমরা।' তিনি জানান, মোবারকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ১৬ জুলাই।
মোবারক হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল কালের কণ্ঠের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিকে বলেন, 'আমি ওই সময় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিছু মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে। তবে আমার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের প্রমাণ পেলে শাস্তি মাথা পেতে নেব।'
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের বিচারকাজ চলছে ট্রাইব্যুনালে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, মোবারক হোসেনসহ আরো ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাঁদের মধ্যে দুজন এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা হলেন জামায়াত নেতা আবদুস সোবহান ও মীর কাসেম আলী। এ ছাড়া একাত্তরে হত্যার অভিযোগে স্থানীয়ভাবে দায়ের করা মামলায় কারাগারে আছেন রাজশাহীর বাগমারার লাহার আলী শাহ এবং পটুয়াখালীর শান্তি কমিটির নেতা রুস্তম শিকদার।
তদন্ত সংস্থার সদস্য আতাউর রহমান জানান, বাগমারা এলাকার লাহার আলী শাহর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে বাগমারা থানায় মামলাও আছে। ওই হত্যা মামলায় ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হন তিনি। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছেন আতাউর রহমান।
সূত্র মতে, আরো যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে তাঁরা হলেন সায়হাম টেঙ্টাইলের অন্যতম কর্ণধার হবিগঞ্জের সৈয়দ মো. কায়সার, জামায়াত নেতা মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, যশোরের কেশবপুরের সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন, ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র এম জাহিদ হোসেন ওরফে খোকন রাজাকার, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও বিএনপির নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী।
সূত্র জানায়, যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে এবং যাঁদের নতুন করে তালিকায় নেওয়া হচ্ছে তাঁরা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারেন সে জন্য বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে তালিকা পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তদন্তের শুরুর দিকে সাধারণ মানুষের সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে ভীতি কাজ করলেও সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অনেকেই এখন অভিযোগ তুলে ধরছেন তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য এম সানাউল হক গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্তকাজে সাধারণ মানুষের আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি। শুরুর দিকে যতটা জটিল ছিল, এখন ততটা নেই। ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে।'
তদন্ত সংস্থার এক সদস্য জানান, যশোরের কেশবপুরের এক নারীর স্বামীকে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির নেতা সাখাওয়াত হোসেনের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই নারীর বয়স এখন ৮০ বছর। এত দিন তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। কিছুদিন আগে কেশবপুরে তদন্তদল যাওয়ার পর সেই বৃদ্ধা স্বেচ্ছায় কথা বলতে চান। তাঁর কাছ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অনেক তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে : এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তাঁরা হলেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলীম, বুদ্ধিজীবী হত্যার অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান। তাঁদের মধ্যে চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান ছাড়া অন্যদের বিচারকাজ চলছে।

No comments

Powered by Blogger.