বেতিয়ারা :সহযোদ্ধার অঞ্জলি by হিলাল ফয়েজী

পৃথিবী আছে, মানুষ আছে, সমাজ-সংসার-পরিবার আছে। আছে পূর্বসূরি, আছে উত্তরাধিকার। দেড় বছরের পৌত্রকে নিয়ে মধ্যবিত্তের গুচ্ছ আবাসন ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ১০ নভেম্বর, ২০১২ তারিখের হাল্কা হিমেল সকালে দাঁড়াতে হলো। উত্তরাধিকার শিশুটি কাক দেখে আনন্দ-চিৎকারে মত্ত হয়।


তার আনন্দে সায় দিতে হয় ষাটোর্ধ্ব আমাকেও। হঠাৎ বুকের ভেতরটা যন্ত্রণার নিঃশব্দ আর্তনাদে ভরে যায়। কাকটি উড়াল দিয়ে বসল একটি তিনতলা বাড়ির ছাদের কার্নিশে। সেই বাড়িটি ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা প্রান্তরে বাঙালি জাতিসত্তার স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির সুতীব্র মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া শহীদ নিজামুদ্দিন আজাদের।
ধানমণ্ডি ৬/এ সড়কের ওই বাসভবনটি ডেভেলপারের স্পর্শমুক্ত এখনও। না, কারও করুণায় নয়, আজাদের স্মৃতি রক্ষার মানসেও নয়। আজাদের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের স্মৃতিময় ভবনটি জমিসহ এখন প্রায় শতকোটি টাকার সম্পত্তি, মুক্তিযুদ্ধের এই ৪১ বছর সময়কালে। এ সম্পত্তি গ্রাসের জটিল ষড়যন্ত্র এটাকে এখনও বহুতল নব আবাসনে উত্তরিত হতে দেয়নি। আজাদ যদি বেঁচে থাকতেন, রাস্তার এপারে উত্তরাধিকার ক্রোড়ে আমি, ওপারে আজাদ উত্তরাধিকার সমেত_ এমন একটি দৃশ্যের কথা ভেবে কেমন বিষণ্ন-বেদনার্ত হলাম এই সকালে।
আজাদের এ বাসভবনটির ভেতরে জীবনে একবার গিয়েছিলাম স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ও সংস্কৃতিকর্মী মনজুর আলী নলতুকে নিয়ে। আমরা তিনজনই বেতিয়ারার সে রাতের খণ্ডযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া আজাদের সহযোদ্ধা, ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্য। ১১ নভেম্বর রাতে আজাদকে রণক্ষেত্রে হারিয়েছি। শহীদের জনক আর জননীকে এ সংবাদটুকু জানানোর দায়িত্ব বুঝি রণক্ষেত্রের দায়িত্বের চেয়েও অনেক অনেক কঠিন, দুরূহ। শহীদ জনক কামরুজ্জামান, মিয়ানমারে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত, প্রজ্ঞাবান-স্থিতধী, সন্তান হারানোর শোক সহ্য করার অশেষ প্রয়াসে রত। আজাদ জননী তখন মানব ইতিহাসের সব শহীদ জননী প্রতিনিধি। এমন আকুল হাহাকার, এমন ব্যাকুল ক্রন্দন, তার পরাণনিধি আজাদ যে বেঁচেই আছে সে বিশ্বাস তার প্রগাঢ় এবং প্রবলতর_ এমন দৃশ্য কেউ না দেখলে অনুধাবন করা অসম্ভব। শুধু মনে হলো, সহযোদ্ধাদের হারিয়ে বেঁচে থাকাই বুঝি এক গভীর অপরাধ, কী সান্ত্বনা দেব আমাদের সম্মিলিত ইতিহাস-জননীকে!
এমন আত্মত্যাগ আর গৌরবে ভরপুর একাত্তর অতীতের কথা ভুলে যাওয়ার উপদেশ এদেশে-ওদেশের নানা শক্তি, নানা ব্যক্তি প্রদান করে ইতিহাস-মূঢ়তার স্বাক্ষর রাখে বারবার। ইতিহাস উপহাস করে ওদের। ভাষা-ভূমি এবং মুক্তির জন্য সংগ্রামের এমন সমুজ্জ্বল ভাণ্ডার আর ঐশ্বর্য এই বাংলা ভূখণ্ডের। এমন সম্পদ থেকে আমাদের বঞ্চিত হওয়ার পরামর্শ যারা প্রায়ই দেন তাদের জন্য করুণাই হয়।
আমাদের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাচের সামরিক প্রশিক্ষিত ৪০০ জনের একাংশ আমরা। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক মিলিয়ে আমরা ৬৮ জন। ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুরে প্রশিক্ষণ শেষে ত্রিপুরার কাইখুড়ায় ক্যাম্প করে অবস্থানের পর ১১ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিতে প্রবেশ করছিলাম নানা প্রস্তুতি নিয়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পাড়ি দিচ্ছিলাম বেতিয়ারা গ্রাম দিয়ে। হঠাৎ অ্যাম্বুশ করে ওতপেতে থাকা পাকিস্তানি শত্রুসেনা ও তাদের সহযোগীরা আমাদের ওপর আঘাত হানল। প্রধান বিপদের মুখোমুখি হলো আমাদের বাহিনীর সম্মুখভাগের স্কাউট গ্রুপ, শহীদ নিজামুদ্দিন আজাদ ছিলেন যার অগ্রভাগে। ধৃত হয়েছিলেন আজাদ আর বশির মাস্টার। আরও একজন। তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফেনীর পাকিস্তানি বড় ঘাঁটিতে। আর খোঁজ মেলেনি। রণক্ষেত্রে শহীদ হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আওলাদ আর স্কুলছাত্র সউদ, চাঁদপুরের কাইয়ুম। সদ্য ছাত্র ইউনিয়ন অতিক্রম করে কৃষক সংগঠনে সার্বক্ষণিকভাবে যোগ দেওয়া প্রতিশ্রুতিশীল লেখক সিরাজুম মুনীর বেতিয়ারা শহীদদের একজন। ওই রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সৃষ্ট সাহস আর বীরত্বের এক অমরগাথার কাহিনী।
বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরার কিষান সন্তান দুদু মিয়া। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধৃত হওয়ার পর ওরা অস্ত্র বাগিয়ে বলল, 'বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ!' পৃথিবীর সব মুক্তি সংগ্রামকে সম্মানিত করে দুদু মিয়া বলে উঠলেন 'জয় বাংলা'। শত্রুরা ওকে গুলিবিদ্ধ করল এবং বলল, 'বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। দুদু মিয়া বললেন, 'জয় বাংলা।' তৃতীয়বারে আরও একঝাঁক গুলি, অনন্ত চরাচরে তখন দুদু মিয়ার আদিগন্ত নিনাদ 'জয় য় য় য় বাংলা'। দুদু মিয়ার রক্তধারায় বেতিয়ারা রণক্ষেত্র পবিত্রতর। এমন দুদু মিয়া মহাকালের মহা গগনের সাহস-নক্ষত্র, বীরশ্রেষ্ঠ।
আমাদের পারাপারে দু'জন স্থানীয় গাইড আবদুল কাদের এবং শফিউল্লাহও রণক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছেন, যাদের কোনো ছবি আমরা পাইনি। বেঁচে থাকা আমরা ৫৯ জন এখন কে, কোথায় ছড়িয়ে রয়েছি, দেশ-বিদেশে। আমাদের অধিনায়ক আছেন মন্ত্রিসভায়, বেতিয়ারায় সে রাতে বেঁচে যাওয়া রায়পুরার কিশোর বাচ্চু এখন কোথায়? অঞ্জলি সবাইকে।
পৃথিবী আছে। মহাকাল আছে। মানবমুক্তির সংগ্রাম চলমান, বহমান। বেতিয়ারা রণক্ষেত্রের মুক্তি সংগ্রাম মহাকালের গভীরে জেগে থাকা কোটি নক্ষত্রের অন্যতম উজ্জীবন হয়ে প্রাণিত করেই চলবে আমাদের।

হিলাল ফয়েজী : প্রকৌশলী ও মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.