স্মরণ- সাহসী এক লড়াকু সৈনিক by শওকত মাহমুদ

আজ ১১ নভেম্বর স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্রসেনানী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা, ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক এবং প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য জাতীয় বীর মেজর এম এ গনির ৫৬তম মৃত্যু দিবস। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বাঙালি সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে মেজর গনি তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল স্যার মেসারভিকে এক আবেদনপত্রে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি আলাদা রেজিমেন্ট গঠনের দাবি উপস্থাপন করেন।


তাঁর এই যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে সে সময় স্যার মেসারভি মেজর গনির এ দাবি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছেও মেজর গনি বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে মেজর গনি ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অগ্রযাত্রা শুরু করেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনে মেজর গনি যে সাহস, শক্তি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশি জাতির জন্য উজ্জ্বল প্রদীপ প্রজ্বালন করেছিলেন, তাঁর শিখা আজও আকাশে নক্ষত্রের মতো চির সমুজ্জ্বল। জাতির ইতিহাসে তাঁর এই নিরন্তর কর্মপ্রয়াসের চিহ্ন কোনোকালেই মুছে যাওয়ার নয়।
মেজর আবদুল গনির জন্ম ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ১৯৪১ সালে মেজর গনি যোগ দেন ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাইওনিয়ার কোরে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে। মেজর গনি একজন সাহসী অফিসার ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার দিন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে এক চা-চক্রে তদানীন্তন জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের উর্দু ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলে মেজর গনি তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতে পারলে বাঙালি সেনারা বাংলা ভাষাতেই কথা বলবে। তিনি সেই দিন যে দৃঢ়তা আর সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তা সত্যিই ইতিহাসে বিরল। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমেই মেজর গনি মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। সুতরাং মেজর গনি শুধু একজন সেনা অফিসার ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক।
সারা দেশ থেকে তরুণদের নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এই রেজিমেন্ট গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পত্তন ঘটে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সেনাসদস্যরা অসীম সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন এবং লড়াই করেন।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর তিনি যে স্বস্তি পেয়েছিলেন, তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ, পাকিস্তানি শাসকেরা তাঁকে পদোন্নতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখে। তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৫৩ সালে সামরিক চাকরি থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর মেজর গনি যোগ দেন রাজনীতিতে। জনসেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজ জেলা কুমিল্লার বুড়িচং থেকে বিপুুল ভোটে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। স্বতন্ত্র সদস্য হয়েও মেজর গনি ব্যতিক্রমী মেধা-মননের জন্য আইন পরিষদে সবার নজর কাড়েন। এলাকা ও দেশের উন্নয়নের জন্য তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মেজর গনি অকালে পরপারে পাড়ি জমান। ১৯৫৭ সালে জার্মানি সফরকালে তিনি হূদেরাগে আক্রান্ত হন। এরপর একপর্যায়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইহকাল ছেড়ে যান এই সাহসী ও সংগ্রামী সৈনিক। কুমিল্লা শহরে তাঁর জানাজায় অংশ নিতে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। এই বীর সৈনিকের ৫৬তম মৃত্যু দিবস উপলক্ষে সেনাবাহিনী, মেজর গনি পরিষদ ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কুমিল্লা সেনানিবাসে তাঁর সমাধিসৌধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরপর মেজর গনি পরিষদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। আজ মেজর গনির জন্মস্থান নাগাইশ গ্রামে বাদ আসর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
শওকত মাহমুদ
সভাপতি, মেজর গনি পরিষদ এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন

No comments

Powered by Blogger.