কালীকচ্ছ সম্মিলনী : ইতিহাসের নিয়তি ও মানুষের দায়

১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক দেশভাগের পটভূমিতে পূর্ব বাংলার হিন্দু এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই চিরাচরিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলার ঔপনিবেশিক ডিভাইড অ্যান্ড রোল নীতিজনিত এক রাষ্ট্রনৈতিক ভয় জন্ম নেয়। এ ভয় উভয় বঙ্গের দুই সম্প্রদায়কে স্বভূমে মনোজাগতিকভাবে করে তোলে পরবাসী।


এই মনোজাগতিক পরবাসের বাস্তব প্রকাশ হলো দেশত্যাগ, দাঙ্গা ও অবশেষে সামাজিক ডেমোগ্রাফির বিপর্যয়কর পালাবদল। এই পালাবদলের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এবং এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর কাল থেকে নব্বইয়ের দশকের বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাজনিত কারণের পাশাপাশি মনস্তাত্তি্বক নিরাপত্তার লক্ষ্যেও বাংলাদেশের ব্যাপকসংখ্যক হিন্দু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে অভিবাস গ্রহণ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার উত্তরাঞ্চলের এমনই অভিবাসী-দেশত্যাগী হিন্দুদের এক মিলনমেলা ২৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। আগামীকাল রোববার এই মেলা শেষ হবে। আশাবাদের বিষয় হলো, স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধাসহ কালীকচ্ছ-নোয়াগাঁও জনপদের সুধীজনই কালীকচ্ছ সম্মিলনীর আয়োজন ও আতিথ্যের ভার গ্রহণ করেছে। ভারতীয় লোকসভার সাবেক সদস্য অমিতাভ নন্দী, ত্রিপুরা রাজ্যের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পবিত্র কর, শ্রীমতী রমা দাস ও ইলা নন্দীসহ শতাধিক অভিবাসী এই কালীকচ্ছ সম্মিলনীতে যোগ দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের আবহমান স্রোতধারা একটি সমাজে বহু কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। স্থানীয় অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে সমাজসেবক আবুল কালাম মৈশান ও অ্যাডভোকেট আবু বকরের আকস্মিক প্রয়াণ কালীকচ্ছ-নোয়াগাঁও জনপদের সমাজ-সংস্কৃতিতে সৃষ্টি করেছে বিরাট শূন্যতা। আবার ভাষাসংগ্রামী-মুক্তিযোদ্ধা ও সরাইল ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শেখ মোঃ আবু হামেদও আজ জীবন সায়াহ্নে উপনীত। এই বাস্তবতায় দুই বাংলার মিলনমেলা শান্তি-সৌহার্দ্যের নববার্তা নিয়ে আসবে_ এমনই কায়মনো প্রত্যাশা আমাদের।
ব্রিটিশ-ভারতের একদা সমৃদ্ধ কালীকচ্ছ গ্রাম ছিল রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির তীর্থকেন্দ্র। স্বদেশি আন্দোলনের বিখ্যাত সশস্ত্র বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, সর্বধর্ম যোগমণ্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা ধর্মসাধক মহারাজ আনন্দ স্বামী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কালীকচ্ছে এই সম্মিলনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের এক মহামিলনের বার্তা তৈরি হয়। রাষ্ট্রের সীমানির্ধারক রাজনীতি বিভেদাত্মক সংস্কৃতির সূচক হলেও ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির প্রত্নতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যই হলো এর মিলনধর্মী আত্মীয়তামূলক বহুত্ববোধকতা।
রাষ্ট্রভিত্তিক বিভেদাত্মক সংস্কৃতির বিপরীতে মহামতী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'স্বদেশী সমাজ' রচনায় ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির চিহ্নায়নে যেমন বলেন, "মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল" (আত্মশক্তি, পৃ. ৫৩৫)। এই চেষ্টার নৈতিকতার সূত্র সন্ধান করে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, "দূর আত্মীয়ের সঙ্গেও সম্বন্ধ রাখিতে হইবে, সন্তানেরা বয়স্ক হইলেও সম্বন্ধ শিথিল হইবে না, গ্রামস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বর্ণ ও অবস্থা নির্বিচারে যথাযোগ্য আত্মীয়সম্বন্ধ রক্ষা করিতে হইবে; গুরু-পুরোহিত, অতিথি-ভিক্ষুক, ভূস্বামী-প্রজাভৃত্য সকলের সঙ্গেই যথোচিত সম্বন্ধ বাঁধা রহিয়াছে। এগুলি কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত নৈতিক সম্বন্ধ নহে_ এগুলি হৃদয়ের সম্বন্ধ। [...] আমরা যে কোন মানুষের যথার্থ সংস্রবে আসি, তাহার সঙ্গে একটা সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া বসি" (পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩৫)। রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ নির্ণয়ের দর্শন যা অবধারিতভাবেই রাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত সংকীর্ণতাকে নাকচ করে দিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রের মানচিত্র সীমিত কিন্তু মানুষের মনের মানচিত্র প্রসারিত, আকাশের মতো দিগ্গ্বলয়-অতিক্রমী, দূরগামী। ফলে চিরকাল যেমন যুদ্ধ, দাঙ্গা ও দেশভাগ হয়েছে, তেমনি অমৃত প্রেরণায় শান্তি ও মিলনের পক্ষে সবার ওপরে মানুষ নিজের মনুষ্যত্বকেই ঠাঁই দিয়েছে। উপনিবেশবাদের দোজখ-তুল্য ফলাফলে ভারতের অখণ্ড মন খণ্ড-বিখণ্ড একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে আজ। এ আমাদের ইতিহাসের নিয়তি, রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতায় এ অঞ্চলের মানুষের মনোজাগতিক প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভাংচুর ঘটেছে, রাতের পর রাত দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছে। সর্বোপরি, কয়েক প্রজন্মের সামষ্টিক স্মৃতির জগতে বিপর্যয় ঘনিয়ে এনেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির পূর্ববর্তী দিনগুলোয় জনগণের রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও নেতাদের অপরিণামদর্শিতার এ হলো প্রায়শ্চিত্ত।
তথাপি রাষ্ট্রের চাণক্যনীতি দিয়ে মানুষ তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্যকে চিরদিন বেড়ি পরিয়ে বেঁধে রাখে না। সামষ্টিক স্মৃতিকে পুনর্গঠনের ব্রত নিয়ে, ইতিহাসের বিভ্রান্তিজনিত কুফলে অবদমিত আবেগকে মুক্তধারায় প্রবাহিত করার ফুর্তিতে ঘুরে দাঁড়ায়, ফিরে তাকায়। তবেই তো আমরা শুনতে পাব রবীন্দ্রনাথের আত্মসন্ধানী সেই কণ্ঠস্বর :
বহুর মধ্যে ঐক্য-উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য স্থাপন_ইহাই ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ধর্ম। ভারতবর্ষ পার্থক্যকে বিরোধ বলিয়া জানে না, সে পরকে শত্রু বলিয়া কল্পনা করে না। এইজন্যই ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া, একটি বৃহৎ ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই সে স্থান দিতে চায়। এইজন্য সকল পন্থাকেই সে স্বীকার করে_স্বস্থানে সকলেরই মাহাত্ম্য সে দেখিতে পায় (পূর্বোক্ত,আত্মশক্তি ৫৫০)।
কালীকচ্ছ সম্মিলনী_ দেশত্যাগী হিন্দুদের কালীকচ্ছের মাটির বুকে, পূর্ব বাংলার এই সোঁদা ভূমিতে ফিরে এসে মিলিত হওয়ার এই উৎসব_ আমাদের অস্তিত্বের মাহাত্ম্যকেই পুনরায় মূর্ত করে, ঋজু করে। রাষ্ট্রের বিভেদ ঘুচিয়ে, কাঁটাতারের শঙ্কা নাশ করে, দীর্ঘ বিচ্ছেদের সংকোচ সরিয়ে আমরা যেন আজ মহামানবের সাগরতীরে দাঁড়িয়েছি। ঢেউয়ের শব্দে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় হৃদয় মাঝে যেন অভয় বাজে :
সময় আসিয়াছে যখন প্রত্যেকে জানিবে আমি একক নহি_আমি ক্ষুদ্র হইলেও আমাকে কেহ ত্যাগ করিতে পারিবে না এবং ক্ষুদ্রতমকেও আমি ত্যাগ করিতে পারিব না (পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩৯)।
কালীকচ্ছের সন্তানদের কালীকচ্ছের মাটিতে স্বাগত জানাই, অভিবাদন জানাই, আবাহন করি। তৃতীয় কালীকচ্ছ সম্মিলনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও মিলনের বোধ আরও দৃঢ় হোক, শিকড় বিস্তার করুক।
 

No comments

Powered by Blogger.