চিরকুট- আলেপ্পোর কবি by শাহাদুজ্জামান

সিরিয়ার আলেপ্পো শহর জ্বলছে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর, যার কথা শেক্সপিয়ার উল্লেখ করেছিলেন তাঁর নাটকে, যা ছিল একসময় ইতিহাসখ্যাত সিল্ক রুটের অন্যতম একটি বন্দর, সেটি এখন বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত। অথচ মাত্র বছর খানেক আগে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপে দেখেছি এই শহরকে।


বিশ্ব স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি গবেষণার কাজে সিরিয়ায় গিয়েছি বেশ কয়েকবার, সময় কাটিয়েছি আলেপ্পোতে। পাথরের বাড়ি, রাস্তার এপারে মসজিদ আর ওপারে গির্জা, ‘সুক’ নামে পরিচিত গলি, তস্য গলির জটিল গোলক ধাঁধার শত শত দোকানসংবলিত প্রাচীন বাজার, একই সঙ্গে রাস্তায় সর্বশেষ মডেলের গাড়ি, মেরিলিন মনরো নামে আধুনিক ফাস্টফুডের দোকান, সব মিলিয়ে ভিন্ন রকম এক আমেজ সেই শহরের। সেখানে পরিচয় হয়েছে কবি ফুয়াদের সঙ্গে। পেশায় চিকিৎসক কিন্তু সিরিয়ার সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম কবি একজন। আরবি সাহিত্যের অগণিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সিরিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। লেবাননপ্রবাসী সিরিয়ার প্রখ্যাত কবি, এডোনিস, যাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের তালিকায় এসেছে একাধিকবার, তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে কবিতা পাঠ করেছেন। ফুয়াদের সঙ্গে আলেপ্পো শহরে কেটেছে চমৎকার কিছু সময়। ফুয়াদকে নিয়ে সুকের ভেতর ঘুরেছি, প্রায় সাত-আট শ বছর আগে এটি ছিল সিল্ক রুটের প্রাণকেন্দ্র, যা একইভাবে প্রাণবন্ত দেখেছি তখনো। বাহারি আরবি গয়নার দোকান, ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি বাকালাবা, সিরিয়ার বিখ্যাত জলপাইয়ের সাবান দেখতে দেখতে হেঁটেছি। লোকের হাতে হাতে সেদ্ধ ভুট্টা, আলেপ্পোর জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড। বাজারে ফেরিওয়ালাদের চিৎকার। আলেপ্পোর ফেরিওয়ালাদের রসিকতা বিখ্যাত জানিয়েছিলেন ফুয়াদ। ধারালো ছুরি বিক্রি করছে এক ফেরিওয়ালা। ফুয়াদ জানালেন, সে হাঁকছে কে তার শাশুড়িকে খুন করতে চায়? আসুন, আমার কাছে আসুন, ব্যবস্থা আছে। একদিকে প্রাচীন পাবলিক বাথ ‘হাম্মামখানা’। চারদিকে একটা উৎসবের আমেজ।
ফুয়াদের সঙ্গে বসেছি আলেপ্পোর ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁয়। অতীতের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলো এখন রূপান্তরিত হয়েছে রেস্তোরাঁয়। অন্দরমহল, বাহিরমহলের আরবীয় সাজসজ্জায় অনন্যসাধারণ পরিবেশ সেই সব রেস্টুরেন্টের। পুদিনার রসের ঠান্ডা শরবত, ট্যাবুলা সালাদ, হামুস, বিবিধ কাবাব আর রুটির বিখ্যাত মেডিটেরিনিয়ান খাবার খেতে খেতে আমরা সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিয়েছি। পাশে বিশাল পাইপ হুঁকা, যাকে ওরা বলে নারগিলে বা শিশা, তাতে মাঝে মাঝে টান দিয়েছেন ফুয়াদ। পেছনে বেজেছে কিংবদন্তি আরবি গায়িকা ফায়রুজের গান ‘হাবিবি, হাবিবি’। আমরা দুজন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হয়েও কী করে সাহিত্যে এলাম, সে গল্প করি। চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানকে কী করে ফুয়াদ কবিতায় রূপান্তরিত করেছেন, তার উদাহরণ দেন। ‘কার্টিলেজ’ নামে তাঁর একটি কবিতা আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনান ফুয়াদ। কার্টিলেজ দেহের এমন একটি অংশ, যেটি ঠিক হাড় নয় আবার মাংসপেশিও নয়। সেই কার্টিলেজের আত্মপরিচয়-সংকট নিয়ে সেই কবিতা। আমি আমার লেখালেখির বিষয় নিয়ে বলি। কবিতা না লিখলেও আমার প্রিয় কবিদের কথা বলি। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটি আমার অক্ষম অনুবাদে তাঁকে শোনাই। কবিতাটি শুনে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান ফুয়াদ। পরে ক্লিনটন বুথ সিলির অনুবাদ করা সেই কবিতাটি পাঠালে ফুয়াদ ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের মাঝে খেলা করে’ এই লাইন কটি তাঁর ফেসবুকের শিরোনাম লাইনে পরিণত করেন। সিরিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা হয় ফুয়াদের সঙ্গে। আলেপ্পোর আপাত সুখী চেহারার পেছনে গভীর উদ্বেগের কথা বলেন তিনি, দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনে রাজনৈতিক স্থবিরতার কথা বলেন, চারদিকে লুকিয়ে থাকা শাসক বাশার আল-আসাদের গুপ্তচরদের কথা বলেন, যারা যেকোনো ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বেড়ায়, গোপনে গ্রেপ্তার করে, হত্যা করে। বলেন অবিরাম ভীতিতে থাকতে থাকতে সিরীয় জনগণের ভেতর জন্ম নেওয়া নিষ্ক্রিয়তার কথা। ফুয়াদ আক্ষেপ করে বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি সিরিয়ায় কোনো পরিবর্তনের হাওয়া দেখবেন কি না সন্দেহ।
অথচ আমাদের এই আড্ডার মাস খানেকের মধ্যেই আরব অঞ্চলে ঘটতে শুরু করে অভূতপূর্ব ঘটনা। গণ-অভ্যুত্থানে এক এক করে পতন ঘটতে থাকে মিসর, তিউনিসিয়াসহ অন্যান্য দেশের স্বৈরশাসকের। এই জোয়ারের সর্বশেষ ঢেউ লাগে সিরিয়ায়। কিন্তু সিরিয়ার শাসক বাশার ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ব্যাপারে অনড় থাকেন। বিদ্রোহ পরিণত হয় গৃহযুদ্ধে। ক্রমেই ওত পেতে থাকা নানা আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে সিরিয়ার মাটিতে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো পরস্পরবিরোধী স্বার্থ আর আরব রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতমুখী স্বার্থ পুরো পরিস্থিতিকে করে তোলে জটিল, ভয়াবহ। এই গৃহযুদ্ধে ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে সিরিয়ার হাজার হাজার নিরীহ মানুষ, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে লাখ লাখ নাগরিক। ই-মেইল, ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই ফুয়াদের সঙ্গে। জানতে পারি সেই জমজমাট সুক এখন ধ্বংসস্তূপ, যে রেস্তোরাঁয় বসে আমরা ফায়রুজের গান শুনেছি, সেটি আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন, তাঁর একাধিক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত, তাঁর স্ত্রী, সন্তানেরা দামেস্কের কাছে এক দূরবর্তী গ্রামে পলাতক আর তিনি আলেপ্পোতে গৃহবন্দী হয়ে আছেন দিনের পর দিন। কিছুদিন আগে ফেসবুকে ফুয়াদ লিখেছেন, ‘অন্ধকার রাত। সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই। আমি অন্ধকারে বসে বাড়ির জানালা দিয়ে আমার প্রিয় শহর আলেপ্পোকে দেখি। বিরান, বিধ্বস্ত। থেমে থেমে গুলির আওয়াজ শুনি। হঠাৎ চারদিকে আলো করে দূরে একটা শেল পড়ে। আমার চোখের সামনে ছায়ায় ঢাকা আলেপ্পো। কিসের ছায়া এসব? আমার শৈশবের স্মৃতি থেকে উঠে আসা গল্পের অতিকায় কোনো বৃক্ষের ছায়া কি? নাকি সেসব মায়ের বাষ্পীভূত অশ্রু দিয়ে গড়া মেঘের ছায়া, যাঁদের সন্তানেরা অদৃশ্য হয়ে গেছে, পরিণত হয়েছে সংখ্যায়, সংবাদ বুলেটিনে। আলেপ্পো আমার, এখানে আর কোনো বাঁশি বাজে না এখন, অপরূপ দেহবল্লরিতে আর নেচে ওঠে না কেউ। কেবল অন্ধকার থেকে এক এক করে জেগে ওঠে ভয়াল জন্তু।’
আপাত নিরবচ্ছিন্ন, ঘটনাহীন একটি দেশ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পরিণত হয়েছে এমন এক ভীতিপ্রদ জনপদে। কিন্তু এটি অনেক দূরবর্তী দেশের বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার ভাবার কারণ দেখি না। একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানেরা যদি দীর্ঘদিন দায়িত্বহীন আচরণ করেন, যদি তাঁরা দিনের পর দিন জনগণের কণ্ঠস্বর শোনার অনাগ্রহ দেখান, যদি জনগণ থাকে নিষ্ক্রিয়, যদি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের শক্তি এবং দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া না যায়, তবে যেকোনো দেশই এমন একটি পরিস্থিতির ভেতর পড়ে যেতে পারে। পড়ে যেতে পারে গভীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জালে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.