ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-নব্বই বছরে আমাদের স্বপ্নযাত্রা by হারুন-অর-রশিদ

বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১৮ মার্চ ‘দ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট’ পাস হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। স্যার পি জে হার্টগ ছিলেন এর প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর। প্রায় ৬০০ একর জমি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।


শুরুতে ছিল মাত্র দুজন ছাত্রীসহ ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী, ৬০ জন শিক্ষক, তিনটি অনুষদ (কলা, বিজ্ঞান ও আইন), ১২টি বিভাগ, তিনটি হল (জগন্নাথ হল, ঢাকা হল ও মুসলিম হল) । বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৩ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী (ছাত্রী প্রায় ৩৫ শতাংশ), শিক্ষক এক হাজার ৬৫৫ (নারী শিক্ষক ৩০ শতাংশ), ১০টি অনুষদ, ৬৭টি বিভাগ, ১৭টি হল, তিনটি ছাত্রাবাস। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে, আটটি ইনস্টিটিউট, ৩৮টি গবেষণাকেন্দ্র এবং ২৩৫টি ট্রাস্ট ফান্ড। বিশ্বের ৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিনিময় সম্পর্ক রয়েছে। ছাত্রীদের জন্য এক হাজার আসনবিশিষ্ট আরও একটি হল নির্মাণাধীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলকাতার পত্রপত্রিকার আশঙ্কা ছিল এটি ধর্মীয় শিক্ষাসর্বস্ব একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কিন্তু তাদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং একটি সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশে বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সেখানে শহর গড়ে ওঠার বহু নজির রয়েছে। যেমন, ব্রিটেনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সেখানকার শহর গড়ে ওঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানও অনেকটা তাই। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত বাঙালি জাতি ও তার রাষ্ট্র, বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস। ’৪৮ ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারও ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয় । এখানকান শিক্ষার্থীরাই তাতে নেতৃত্ব দেয়, বাঙালি তরণের রক্তে রচিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) , জাতীয় মুক্তির সোপান।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। স্বাধীনতার জন্য ছাত্রদের পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন প্রথিতযশা শিক্ষক জীবন দেন। এ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি ছিল Oxford of the East বা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে। শুরুতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী (অনাবাসিক ও অধিভুক্তকারী নয়) প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও সময়ের ব্যবধানে তার বহুমাত্রিক সমপ্রসারণ ঘটেছে। বর্তমানে বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউট, গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত জার্নালের সংখ্যা প্রায় ১০০। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন শিক্ষকেরই গবেষণা-প্রবন্ধ ও পুস্তক বিদেশের বিখ্যাত জার্নালে ছাপা বা প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে? বর্তমানে এর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রতিনিয়ত অধিকতর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে করপোরেট সেক্টরের সহায়তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে, যা আগে প্রায় অনুপস্থিত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য শুধু পঠন-পাঠন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের সৃষ্টি, জ্ঞান অর্জন ও তা বিতরণের কেন্দ্র। এ জন্য আবশ্যক, শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন বোস বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘কোয়ান্টম স্টাটিস্টিকস তত্ত্ব’ রচনা করেন (১৯২৪)। সমপ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আমাদের দেশের বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও তাঁদের সহযোগীরা (যাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগ এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের একদল তরুণ শিক্ষার্থী রয়েছে) পাটের জন্মতত্ত্ব (জিনম সিকোয়েন্সিং) আবিষ্কার করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এই আবিষ্কার আমাদের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক গবেষণাকর্মে শিক্ষকদের উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বায়নের এই যুগে ভৌগোলিক সীমায় দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখলে চলবে না। আমাদের শিক্ষা-গবেষণা হতে হবে বিশ্বমানের। সৃষ্টি করতে হবে বিশ্বমানের গ্রাজুয়েটস। এ জন্য থাকা চাই আধুনিক ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে তথ্যপ্রযুক্তি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। হলে হলে সাইবার সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটি কক্ষে ইন্টারনেট সুযোগ থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে সম্পূর্ণ অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ই-বই, ই-জার্নালের প্রাপ্যতা পর্যাপ্ত করতে হবে। শ্রেণীকক্ষগুলোকে ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত করতে হবে। গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য গবেষণা সামগ্রী ও উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস ও প্রকাশনা সংস্থাকে আধুনিক মানের করতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রকে অন্তত ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করে চিকিৎসা অনুষদের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। ট্রাস্ট ফান্ডগুলোকে নিয়মিত ও কার্যকর করতে হবে। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শুধু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরই যথেষ্ট নয়, তা যাতে কার্যকর হয় সেটি বিশেষভাবে দেখতে হবে। বিদেশি ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে হবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র ‘ফরেন অফিস’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতে হবে। যথাসময়ে পরীক্ষা ও এর ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসব বডির সভা নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনের নির্দিষ্ট তারিখ একাডেমিক ক্যালেন্ডারে দেওয়া থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে সম্পূর্ণ সেশনজটমুক্ত।
২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি হবে। তার আগে ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিখী পালিত হবে। ইতিহাসের পথ ধরে এই তিন মাইল ফলক ঘটনা এক বৃন্তে এসে মিশেছে। আমাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই গুণে-মানে-সৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকেরা জ্ঞান আর গবেষণাকর্মে নিবেদিত থাকবেন। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন-সমৃদ্ধি অর্জনে এ বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের মত ভবিষ্যতেও অগ্রনী ভূমিকা করবে, ৮৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
ড. হারুন-অর-রশিদ: সহ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.