বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-এমপিওভুক্তির ত্রুটিগুলো দূর করতে হলে by সৈয়দা শামসে আরা হোসেন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিভুক্তি সম্পর্কে সম্প্রতি অনেক লেখালেখি হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারী পদে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি অর্থ স্থানান্তর করার পদ্ধতির নামকরণ হয়েছে ‘মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার’, সংক্ষেপে এমপিও।


মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস) শ্রেণীর শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারি অর্থ প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মচারীর নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এমপিও-সুবিধার আওতায় শিক্ষক-কর্মচারী পদে কল্যাণ তহবিল, অবসর-ভাতা তহবিল গঠনের জন্য সরকারি অর্থসংশ্লিষ্ট তহবিলের বিধি অনুসারে প্রতি মাসে বরাদ্দ দেওয়া হয়। দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমপিও-সুবিধার অন্তর্ভুক্ত নয়। আবার এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও-সুবিধা পান না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতি অর্থবছর এমপিও-সুবিধা খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন এবং শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা নির্ধারণ করে।
২০০৯-১০ অর্থবছরের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক হাজার ২২টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়ন সম্পন্ন করে গত মে মাসে। ১০ মে মন্ত্রিপরিষদ সভায় এই তালিকা বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নতুন তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, শিক্ষা উপদেষ্টার সক্রিয় ভূমিকা এবং শিক্ষামন্ত্রীর বিধি-নীতিভিত্তিক কর্মোদ্যোগ সবার চিন্তাকে নাড়া দিয়েছে। এ পর্যন্ত এমপিও-সুবিধার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
এই অঞ্চল ঐতিহাসিক কিছু কারণ ও অবস্থার প্রভাবে শিক্ষায় পশ্চাৎপদ। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশ বিভাগ হওয়ার পরও শিক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সে সময় থেকে সমাজসচেতন মানুষ স্থানীয়ভাবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে শুরু করে। এভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের সহায়তা ছিল খুবই সীমিত ও অনিয়মিত।
স্বাধীনতার পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয় সরকারের বিবেচনায় আসে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস) শ্রেণীর শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জাতীয় বেতন স্কেলের সমপর্যায়ভুক্ত করে বেতন নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত বেতনের প্রারম্ভিক অংশের অর্ধেক অর্থ সরকারি সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মচারী পদে অর্থসহায়তা হিসেবে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হিসাব অনুসারে শিক্ষক-কর্মচারীদের হস্তান্তরের জন্য প্রেরণ করা হতো। এই অর্থ যথাযথভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীদের দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং অর্থের হিসাব সংরক্ষণে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের প্রাপ্যতা অনুসারে বেতন-ভাতা বাবদ অর্থ সরাসরি প্রদানের ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৮৪ সালে ‘মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার’ বা এমপিও-সুবিধা পদ্ধতি সরকার প্রবর্তন করে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত দুই হাজার ৩৮৬টি কলেজ, ১৫ হাজার ৫১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাত হাজার ৩৪৪টি মাদ্রাসা, এক হাজার ৯৫টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও-সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারপর গত ছয় বছর নতুন এমপিওভুক্তি স্থগিত রাখা হয়। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে এমপিওভুক্তি নতুন করে আবার শুরু করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।
এমপিও-সুবিধা পাওয়া কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারি অর্থ অপব্যবহার করা হচ্ছে বলেও শোনা যায়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিও-সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে শুধু শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এর ফলে শিক্ষার মান অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।
এমপিও-সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে কিছু শিক্ষকের মানসিক যন্ত্রণা, আর্থিক অনিশ্চয়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষা কর্তৃপক্ষের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা, এমপিও-সুবিধার অনুরূপ প্রদানের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ করে সে বিষয়ে পরামর্শ দান ও বাস্তবায়ন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
স্নাতক (সম্মান) মাস্টার্স কোর্সের পাঠদানকারী শিক্ষকদের সরকার এমপিও-সুবিধা দেয় না, এর ফলে দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অর্থসহায়তা অনুপস্থিত।
এমপিও-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকের মান, মেধা যাচাই, দক্ষতার মূল্যায়ন করার কোনো বিধিব্যবস্থা নেই। জ্যেষ্ঠতার কারণে এই সুবিধা লাভ ঘটে, এ সত্ত্বে এমপিও-সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষক বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বলে বিবেচিত হন। সে শিক্ষকের পেশাগত দায়িত্ব পালনে ত্রুটি-অনিয়মের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তথ্যবিবরণী ফরমে শিক্ষকের মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা যাচাই বা তুলনামূলক বিবেচনার কোনো পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত নেই। নির্বাচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিও-সুবিধার জন্য শিক্ষক-কর্মচারীর পদসংখ্যা নির্ধারিত থাকায় কর্মরত সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও-সুবিধাভুক্ত হন না। এমপিও বিধির মধ্যে এই দুর্বল ক্ষেত্রসমূহ দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
এমপিও-সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো অর্থ নেবেন না এই মর্মে অঙ্গীকারপত্র জমা দিলেও এই শর্ত লঙ্ঘন করে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক সুবিধা এসব শিক্ষককে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নামকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে অর্থ গ্রহণের বিষয় জানা যায়। এসব আর্থিক অনিয়মের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাশ্রয় ঘটানোর যে উদ্দেশ্য এমপিও-সুবিধা প্রবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত হওয়ার প্রস্তাব ছিল, তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
এমপিও-সুবিধায় বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি করা হয় না। শিক্ষকের পদোন্নতির বিধিও সীমিত, এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও-বহির্ভূত শিক্ষক পদে এসব সুবিধা প্রদান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আন্দোলন আর দাবি নিয়ে সোচ্চার হলে এমপিও-সুবিধা পাওয়া যাবে, এ ধারণা অমূলক প্রমাণ করার পদক্ষেপ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেওয়া আবশ্যক। এমপিও-বিধি ভঙ্গ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক যে অনিয়ম হচ্ছে তা চিহ্নিত করার ব্যবস্থা এবং এই অনিয়ম শাস্তিযোগ্য করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এমপিও-সুবিধা প্রয়োগ ন্যায়ভিত্তিক বিধির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। এমপিও পদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়ন নিশ্চিতির সহায়ক করে তোলা প্রয়োজন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রাপ্তির সমতাভিত্তিক ব্যবস্থা পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
সৈয়দা শামসে আরা হোসেন: সাবেক অধ্যক্ষ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.