আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৮)-'দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে' by আলী যাকের

কাজ থেকে অবসর পেলেই আমি মাঝেমধ্যে ১৪৪ লেনিন সরণিতে যেতাম। সেখানে কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের উদ্যোগে সৃষ্ট 'বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি'র আনুকূল্যে আমাদের মুক্তিযাদ্ধা শিল্পীরা সমবেত হতেন একটি আয়তাকার বড় হলে। সেখানে প্রতিদিন মহড়া চলত গান, আবৃত্তি ইত্যাদির।


এই শিল্পীদের যে সম্মিলন, এখান থেকেই সৃষ্ট হয় 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র। এই দলের শিল্প-সংস্কৃতিসংক্রান্ত সব বিষয়ের সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় গুরু প্রয়াত ওয়াহিদুল হক। এখানে সন্‌জীদা আপাও শুরুতে নিয়মিত গান শেখাতেন। এ ছাড়া সংস্থার অন্যতম প্রধান শিল্পী ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেনু। তাঁদেরই একটি উপদল যখন বাংলাদেশের ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যায় ট্রাকে করে, তাদের সঙ্গে ছিলেন লিয়ার লেভিন। এই দলে আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিয়াউদ্দিন তারেক আলীও ছিলেন। লিয়ার লেভিন এই গোটা সফরটি তাঁর মুভি ক্যামেরায় ধরে রাখেন। পরবর্তী সময়ে সম্প্রতি প্রয়াত তারেক মাসুদ এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ নিজেদের প্রচেষ্টায় লিয়ারের কাছ থেকে ওই ফিল্ম উদ্ধার করে মুক্তির গান তৈরি করেন। জিয়াউদ্দিন তারেক আলী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি মুক্তির গানের ধারাভাষ্যে ছিলেন। আমি সময় পেলে সংস্থার মহড়ায় যেতাম বটে, তবে তা ছিল অনিয়মিত। কেননা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমাকে সার্বক্ষণিকভাবে ব্যস্ত থাকতে হতো নিজের কাজ নিয়ে। ওয়াহিদ ভাই (ওয়াহিদুল হক) ও সন্‌জীদা আপা কিছু অসাধারণ দেশাত্মবোধক গান শিখিয়েছিলেন এই সংস্থার শিল্পীদের।
একবার আমি কিছু বিদেশি সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে কলকাতার অদূরে শরণার্থী শিবিরগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। আমার কাজ ছিল মূলত দোভাষীর দায়িত্ব পালন করা। কাজ শেষে অতিথিদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি শরণার্থী শিবিরে আরো কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । এর পেছনে যে কারণটি কাজ করেছিল তা হলো, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা ওই দিন সন্ধ্যায় শরণার্থী শিবিরে যে অনুষ্ঠানটি করবে সেখানে উপস্থিত থাকা এবং শরণার্থীদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা, বেতারের জন্য। সেদিন উন্মুখ হয়ে ছিলাম ওয়াহিদ ভাই এবং সন্‌জীদা আপার শেখানো গানগুলো শোনার জন্যও। গান শুরু হতেই চমকে উঠলাম। মনে হলো, এই গানটি তো আমি এর আগে কোনো দিন শুনিনি? স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল গানটি ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু এর কথা ও সুর ছিল আমার অজানা। ওই গানের সুর ও কথা আমার কানে আজও সর্বক্ষণ বাজে। 'দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে/নগরে প্রান্তরে বনে বনে। অশ্রু ঝরে দু নয়নে,/পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।' গানটি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় মথিত করে অশ্রুধারা নেমে এলো আমার দুচোখে। ভাবলাম আর কত দিন, মাগো, তোমার স্বাধীনতার জন্য দেশে দেশে, বনে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে হবে আমাদের? তারপর ওই গানেরই ভাষায় 'জ্বলিয়া ওঠে অযুত প্রাণ, এক সাথে মিলি এক গান গায়- /নয়নে অনল ভয়-শূন্য কাঁপে অভ্রভেদী বজ্রনির্ঘোষে!/ভয়ে সবে নীরবে চাহিয়ে।' আবার থমকে গেলাম। আবার আশা জাগে বুকে। যুদ্ধে তো নেমেছি, বজ্র নির্ঘোষে স্লোগান দিয়েছি 'জয় বাংলা'। স্বাধীনতা অর্জনের পরই থামব এবার। এই গানের শেষ চরণে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'ভাই বন্ধু তোমা বিনা আর মোর কেহ নাই/তুমি পিতা, তুমি মাতা, তুমি মোর সকলই/তোমারি দুঃখে কাঁদিব মাতা, তোমারি দুঃখে কাঁদাব/তোমারি তরে রেখেছি প্রাণ, তোমারি তরে ত্যাজিব/ সকল দুঃখ সহিব সুখে/তোমারি মুখ চাহিয়ে।' গানটি শেষ হলো। অন্য কোনো গান ধরলেন শিল্পীরা। আমার চোখ দিয়ে তখনো ঝরছে অঝোর ধারায় অশ্রু। ভাবলাম, কত বড় মাপের স্বপ্নদ্রষ্টা হলে পরে এমন একটি সর্বযুগীয় প্রাসঙ্গিক গান নির্মাণ করতে পারেন একজন স্রষ্টা? ওই দিনের অনেক পরে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে বই পড়ে জানলাম যে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি লিখেছিলেন কুড়ি বছর বয়সে। অর্থাৎ ১৯৭১-এ এই গানটির বয়স হয়েছে ৯০ বছর। এই সুদীর্ঘ ৯০ বছরেও গানটির প্রাসঙ্গিকতা একটুও ম্লান হয়নি। আমার মনে হয়, বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য হাজার বছর ধরে অম্লান থাকবে এই গানের আবেদন। এভাবেই, এমন অমর কাব্যগাথার মধ্য দিয়েই একজন স্রষ্টা চিরায়ত হয়ে যান।
কলকাতার পাশ দিয়ে বয়ে চলে হুগলী নদী। এই নদী ডায়ামন্ড হারবারের পাশ দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে, সুন্দরবনকে একপাশে রেখে মেলে বঙ্গোপসাগরের জলরাশির সঙ্গে। হুগলী নদীকে কলকাতাবাসীরা বলে গঙ্গা। গঙ্গাই বটে এই হুগলী নদী। তবে সেই অর্থে পদ্মাও তাহলে গঙ্গা। এই দুই নদীরই উৎস গঙ্গোত্রী থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী। এই গঙ্গা নদী আমাদের উপমহাদেশের অনেক মানুষের কাছে বড় পবিত্র একটি নদী। অনেক সনাতনপন্থী হিন্দু এর জলে স্নান করে পবিত্র হয়। বিশেষ করে এমন সৌভাগ্য যদি ঘটে যে তারা গঙ্গার উৎসে গিয়ে অবগাহন স্নান করতে পারে এই নদীতে। আবার এই হুগলী নদীতেই হাজারো মানুষ সকাল থেকে বিভিন্ন ঘাটে ভিড় করে গঙ্গায় পুণ্য স্নান করতে। উত্তর কলকাতা থেকে শুরু করে দক্ষিণে খিদিরপুর পর্যন্ত এই ধরনের মেলা ঘাট রয়েছে। বোধ করি আরো আছে, কিন্তু কেবল এই ঘাটগুলোই আমি চিনি। ধর্ম বিশ্বাস ছাড়াও একাধিক কারণে গঙ্গা আমাদের এই উপমহাদেশের জন্য এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ জলপ্রবাহ। একদিকে যেমন এই নদীতে ভেসে পণ্যবাহী জলযানগুলো ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন করে আসছে আবহমান কাল ধরে, তেমনি গঙ্গার বুকে ভেসে নানা জাতের মানুষ আশ্রয় পেয়েছে এই ভূখণ্ডে। গঙ্গার দুই তীর ঘেঁষে উপস্থিত হাজার বছরের বহু বর্ণ, সভ্যতার নিদর্শন। সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ, বৌদ্ধ এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সব মানুষ এসে মিলেছে এক আন্তভারতীয় সভ্যতার অঙ্গে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.