ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ by অদিতি ফাল্গুনী

বাংলা সাহিত্যের একটু মনোযোগী পাঠক মাত্রই আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের শুরু অবধি বাংলা কথাসাহিত্যে হিন্দু-ব্রাহ্ম মতাদর্শিক সংঘাত, হিন্দুসমাজের নানাবিধ পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসেবে ব্রাহ্মধর্মের উত্থান আবার সমাজের বিপুলসংখ্যক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে না পারা কি ব্রাহ্মসমাজের


নিজের ভেতরেই মত ও পথের নানা দ্বন্দ্বে কালপ্রবাহে এ ধর্মের বিলুপ্তি প্রভৃতি বিষয়ে অল্প-বিস্তর অবগত। তবে আজও আমাদের দেশের অনেক সাধারণ মানুষই ‘ব্রাহ্মধর্ম’ বিষয়টি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত নন। অনেকেই ‘ব্রাহ্ম’ ও ‘ব্রাহ্মণ’ গুলিয়ে ফেলেন। অথচ এ দুইয়ের মধ্যে যে প্রবল ঝগড়া! বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধানতম কবি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশ যে ব্রাহ্ম ছিলেন, তা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিষবৃক্ষ উপন্যাসে মদ্যপ দেবেন্দ্রকে ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হিসেবে দেখান এবং সেই সঙ্গে হিন্দু বিধবা নারীর পুনর্বিবাহের প্রবক্তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও দু কথা বলতে ছাড়েন না। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রতিপালিত আইরিশ যুবক ও কট্টর হিন্দু জাত্যভিমানসম্পন্ন গোরার সঙ্গে ব্রাহ্মকন্যা সুচরিতার প্রেম হলেও ধর্মীয় ব্যবধানে ভেঙে যেতে চায় সেই প্রেম। শরৎচন্দ্রের একাধিক উপন্যাসে (পরিণীতা, দত্তা ও গৃহবিবাদ) এই হিন্দু-ব্রাহ্ম মতাদর্শিক সংঘাতের পাশাপাশি আন্তসম্প্রদায় প্রণয়-পরিণয়ও বর্ণিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের বাসমতী উপাখ্যান নামের উপন্যাসে দেশবিভাগের ঠিক আগে আগে ‘বাসমতী’ নামের আড়ালে বরিশাল শহরের একদিকে হিন্দু-মুসলিম আন্তসম্প্র্রদায় চাপা টেনশন, নায়কের নির্জন কারুআকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি সেখানকার ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্মের ক্ষয় পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন ও বঙ্গীয় রেনেসাঁর সংক্ষিপ্ত ইতিকথা
১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট উত্তর কলকাতায় ফিরিঙ্গি কমল বোসের বাসায় প্রথম ‘ব্রাহ্ম সভা’ অনুষ্ঠিত হয়। এ দিনটিকে ব্রাহ্মধর্মের অনুসারীরা ‘ভাদ্রোৎসব’ হিসেবে পালন করে থাকেন। ১৮৩০ সালে বাংলার মোগল নিজামতে চাকরির অপরাধে সামাজিকভাবে একঘরে হওয়া দুই জমিদার ও কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের দুই প্রতিভূ রাজা রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার চিৎপুর সড়কে (বর্তমানে যেখানে রবীন্দ্র সরণি) ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি অথবা ১১ মাঘ প্রায় ৫০০ ব্রাহ্মণ এবং একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের উপস্থিতিতে ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এ দিনটি ব্রাহ্মসমাজে আজও ‘মাঘোৎসব’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়। মূলত রাজা রামমোহন রায় ও দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বেই ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন সূচিত হয়েছিল। তৎকালীন হিন্দু বিশেষ করে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কৌলীন্য প্রথা, শিশুবিবাহ, কঠোর পণপ্রথা, শিশুবৈধব্য, নারী অশিক্ষা, জাতিভেদ বা বর্ণাশ্রমসহ অসংখ্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনই সহস্রাব্দের শাস্ত্রীয় নিগড়ে আটকে পড়া বাঙালি হিন্দুসমাজের অতিদ্রুত সামাজিক ও শিক্ষাগত অগ্রগতি অর্জন সম্ভব করে তুলেছিল। বাঙালি হিন্দুসমাজের এই অগ্রগতি প্রভাবিত করে তোলে অবাঙালি হিন্দুসম্প্র্রদায়সমূহ ও বাঙালি মুসলিম মানসকেও। ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য শিক্ষা, নারীশিক্ষা, প্রাপ্তবয়সে বিয়ে, অর্থকরী কাজের প্রয়োজন, নগরায়ণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সক্ষম হয় গোটা ভারত উপমহাদেশ। উইকিপিডিয়ায় তাই আধুনিক ভারত উপমহাদেশকে এই ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনেরই ইতিবাচক ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের মূল প্রবক্তা রাজা রামমোহন রায় বেদ ও উপনিষদের সারাৎসার আত্মস্থ করে বাতিল করতে চেয়েছিলেন হিন্দুসমাজে প্রচারিত নানা দেব-দেবীর সাকার উপাসনা, একই সঙ্গে তিনি ইসলাম ধর্মের কোরআন-হাদিসও আয়ত্ত করেছেন। ইসলাম ধর্মের কঠোর একেশ্বরবাদিতা ও খ্রিষ্টধর্মের নানা জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
১৮৩০-এর নভেম্বরে রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানেই ১৮৩৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। হিন্দুধর্মের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এই ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা হলেও রামমোহনের অবর্তমানে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মের একটি মৌলিক পশ্চাৎপদ প্রবণতা অর্থাৎ বর্ণাশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেন। যেমন, ব্রাহ্মসমাজের ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সব সদস্যই উপনিষদ পাঠ ও উপাসনাসংগীত শোনার অধিকার পেলেও তেলেগু ব্রাহ্মণদের সংস্কৃত ভাষায় বেদ পাঠ শুনতে পেতেন শুধু ব্রাহ্মণ বর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত সদস্যরাই। রামমোহনের মৃত্যু হতে না হতেই ব্রাহ্ম সভার তেলেগু ব্রাহ্মণ সদস্যরা সাকার উপাসনা বা প্রতিমা পূজায় ফিরে যান। দেবেন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সভার সদস্যসংখ্যাও কমে যায়। যাহোক, ১৮৩৯ সালের ৬ অক্টোবর দেবেন্দ্রনাথ ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ নামে পরিচিত হয়। শুরুতে ঠাকুর পরিবারের ভেতর সীমিত থাকলেও দুই বছরেই ৫০০-এর বেশি সদস্য হয় এই সভার। ১৮৪০ সালে দেবেন্দ্রনাথ কঠোপনিষদ বাংলায় অনুবাদ করেন। বঙ্গীয় রেনেসাঁর অপর দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব অক্ষয় কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই সভায় যোগ দেন। ১৮৫৫ সাল থেকেই অবশ্য ব্রাহ্মসমাজের ভেতরে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল অংশের লড়াই পুনরায় শুরু হয়।
বলা বাহুল্য যে রক্ষণশীল অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের অব্রাহ্মণ সদস্য কেশবচন্দ্র সেনকে দেবেন্দ্রনাথের পুত্র ও রবীন্দ্রনাথের সেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব পছন্দ করলেও দেবেন্দ্রনাথের ক্রমাগত রক্ষণশীল অবস্থানে বিরক্ত হয়ে ১৮৫৯ সালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী সভার সচিবের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে পদত্যাগ করেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথও। দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র ও বিদ্যাসাগরের প্রিয় ছাত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভার দায়িত্ব নেন। পিতার পক্ষে ও প্রগতিশীল কেশবচন্দ্র সেনের প্রতি আপন ভাই সত্যেন্দ্রনাথের সজোর সমর্থনে বিরক্ত হেমেন্দ্রনাথ কলকাতার বাইরেও ব্রাহ্মসমাজ প্রসারে উদ্যোগী হন।

ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা
মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী (পৃষ্ঠা: ১৫৬, প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৯৩, অনন্যা প্রকাশনী) গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৮৬৯ সালে প্রায় ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ মন্দির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। দোতলা এই স্থাপনার প্রধান আকর্ষণ হলো ৫৫ ফুট দীর্ঘ, ২২ ফুট প্রশস্ত ও ২১ ফুট উঁচু একতলার হলঘর। ১৮৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেশবচন্দ্র সেন নিজে উপাসনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠায় স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ পাঁচ হাজার ৮৭৫ জন চাঁদা দিলেও বর্তমানে এই মন্দির দেখাশোনা করছে মাত্র তিনটি ব্রাহ্ম পরিবার। ২৫ মে শুক্রবার বিকেলে পুরোনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নিকটবর্তী এই ‘ব্রাহ্মসমাজ মন্দির’-এ গিয়ে দেখি মন্দির তালাবদ্ধ। শুধু রোববার সন্ধ্যায় উপাসনা হয়। সেই উপাসনাতেও মানুষ প্রায় থাকে না বললেই চলে। কথা হলো ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের সাবেক আচার্য ও কমরেড প্রাণেশ সমাদ্দারের সঙ্গে। আশি পার হওয়া প্রাণেশ সমাদ্দার বর্তমানে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। প্রাণেশ সমাদ্দারের জীবনসঙ্গিনী মঞ্জু সমাদ্দার তাঁর স্বামীর বক্তব্য আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘আমার জন্ম ১৯৩১ সালে। রবীন্দ্রনাথ এই মন্দিরে ১৯২৬ সালে এসে উপাসনা পরিচালনা করেছিলেন। আমিতো দেখি নাই। তবে আমার মা তাঁকে দেখেছেন। বর্ণাশ্রম আর পৌত্তলিকতায় হারিয়ে গেছে ব্রাহ্মধর্ম। মেয়েরা সব হিন্দু ছেলে বিয়ে করেছে। ব্রাহ্মধর্ম কিন্তু প্রগতিশীল। বিশেষ ধর্ম আইন ১৮৭২-এর আওতায় আমি হিন্দু-মুসলিম বা হিন্দু-খ্রিষ্টান কি মুসলিম-খ্রিষ্টান বিয়ে দিয়েছি। তবে খুব বেশি না। এমন দুই শ কি আড়াই শ বিয়ের আচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।’

শেষ কথা
ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন আজ প্রায় হারিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি সমাজদেহের অভ্যন্তরে যে মৃত সঞ্জীবনী এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিল। এক শ কি দেড় শ বছর আগেও বাঙালি হিন্দু নারীর ব্লাউজ বা জুতা পরা, বাঙালি হিন্দু পুরুষের মুরগি বা পাউরুটি খাওয়া ‘বেহ্ম’, ‘খেরেস্তানি’ বা ‘মেলেচ্ছ’ আচার বলে যে গণ্য হতো তার বিবরণ রয়েছে খোদ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেই। শিক্ষিত বা বই পড়া মেয়ে মানেই ব্রাহ্ম তরুণী! হিন্দু নারীর বিয়ে হয়ে যেত আট থেকে দশের ভেতরেই। শিক্ষার কোনো বালাই ছিল না তার। আর আজকের ভারত উপমহাদেশে কোটি কোটি হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষের যে আধুনিক শিক্ষা ও আলোকায়ন সম্ভব হয়েছে, তা এই ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভবপর হতো না।

No comments

Powered by Blogger.