এক অসমাপ্ত যুদ্ধের কাহিনি

‘বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এই যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত কষ্টের। সময় এসেছে সিয়াচেনকে মৃত্যু উপত্যকার পরিবর্তে শান্তির প্রতীকে পরিণত করার।’ সিয়াচেনের বেস ক্যাম্পের সেনাদের উদ্দেশে ২০০৫ সালের জুনে এ কথাগুলো বলছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।


ভারত সরকারের বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়া টুডে সাময়িকী লিখেছে, এরই মধ্যে সিয়াচেন থেকে সেনা প্রত্যাহার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে মনমোহন সিং অনুমোদন দিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু তুষারাবৃত এই যুদ্ধক্ষেত্রে বহু ভারতীয় সেনা তাঁদের জীবন উত্সর্গ করেছেন। এভাবে আর কত দিন চলবে? শান্তি আলোচনার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্য সিয়াচেনকে সেনাশূন্য করার এখনই সময়। ২০০৮ সালে ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়। সরকারের বিভিন্ন মহল মনে করছে, পাকিস্তানের কাছে ভারতের ব্যাপারে আস্থা তৈরিরও একটি প্রক্রিয়া হতে পারে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। এদিকে সমালোচকেরা বলছেন, সিয়াচেন নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের শান্তি আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ হিসেবে নোবেল পুরস্কার বগলদাবা করতে চাইছেন মনমোহন। এর মাধ্যমে তিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেতে চাইছেন।
সিয়াচেন—তুষারাবৃত ত্রিভুজাকার এক ভূখণ্ড। যার অবস্থান পাকিস্তান, ভারত ও চীন—এই তিন দেশের সংযোগস্থলে। ফলে কৌশলগত অবস্থানের কারণেই সিয়াচেনের গুরুত্ব অত্যধিক। মূলত বিতর্কিত কাশ্মীর ভূখণ্ডে অবস্থিত এই অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে প্রায় তিন দশক ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১ হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পার্বত্য যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানকার তাপমাত্রা থাকে শূন্যেরও ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে। যেখানে আচমকা তুষার ধসে নিভে যেতে পারে সেনাদের প্রাণ-প্রদীপ (কিছুদিন আগেই সিয়াচেনে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তুষার ধসে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।)। আর এমনই এক মরণফাঁদে দিবানিশি অতন্দ্র পাহারায় থাকে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাসদস্যেরা। নির্মম এই চূড়া এরই মধ্যে কেড়ে নিয়েছে বহু সেনার প্রাণ। দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি।
যে কারণে সিয়াচেন গুরুত্বপূর্ণ: কৌশলগত অবস্থানের কারণে সিয়াচেন ভারত ও পাকিস্তানের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সিয়াচেনের সালতরো রিজ দিয়ে ভারত অগ্রসর হতে পারলে তারা চীনের কাছাকাছি চলে যেতে পারবে। এতে চীনে পাকিস্তানের প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গিলগিট ও বালতিস্তানের নিয়ন্ত্রণও নিতে পারবে ভারতীয়রা এবং কারাকোরাম মহাসড়ক বন্ধ করে দিতে পারবে।
১৯৯৯ সালে কারগিলের কিছু অংশ দখল করে নেয় পাকিস্তানি সেনারা। কারগিল হাতছাড়া হয়ে গেলে পুরো কাশ্মীরও বেদখল হয়ে যেতে পারে; এ আশঙ্কায় ভারতীয় বাহিনী তখন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
প্রকৃতপক্ষে, এই অঞ্চলগুলোর সীমানা ঠিক ওভাবে নির্ধারণ করা নেই। বরং নিয়ন্ত্রণরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা আছে। এর ফলে যে দেশ বেশি বলপ্রয়োগ করতে পারে, সে দেশ অনির্ধারিত এলাকা দখল করে নিতে পারে। কিন্তু, কোনো ভূখণ্ড যতই অগুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, রাষ্ট্র তা রক্ষা করতে মরিয়া। কাজেই ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের ভাগ্য নির্ধারণে সিয়াচেনের ভূমিকা অনেক।
শুধু ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, সিয়াচেনের তুষার গলা পানি থেকে সৃষ্টি হয়েছে নুবরা নদী। কিছু দূর প্রবাহিত হয়ে নুবরা মিলিত হয়েছে শিয়ক নদীর সঙ্গে। শিয়ক আবার মিলেছে সিন্ধু নদের সঙ্গে। যা কি না ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই কোটি কোটি রুপি খরচ করে উভয় দেশ সিয়াচেনে সেনা মোতায়েন করে আছে।

No comments

Powered by Blogger.