বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪১২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আলমগীর সাত্তার, বীর প্রতীক চৌকস এক বিমানসেনা ঘন বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ এক পাহাড়ি এলাকায় ডাকোটা বিমান নিয়ে নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ নিলেন আলমগীর সাত্তার (কাজী আবদুস সাত্তার)।


স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে রপ্ত করলেন রাতের আঁধারে আধুনিক দিকদর্শন যন্ত্র ছাড়াই বিমান চালনা এবং শত্রুর রাডার ফাঁকি দিয়ে মাত্র ২০০ ফুট উচ্চতায় বিমান নিয়ে উড়ে যাওয়ার কৌশল। আরও প্রশিক্ষণ নিলেন, কেমন করে শত্রুবিমানের আক্রমণ মোকাবিলা করতে হয়, কত দূর থেকে রকেট ছুড়তে হয়, কীভাবে নিশানা লক্ষ্য করে বোমা ফেলে কত কোণে ডাইভ দিতে হয়, বিমানে থাকা মেশিনগান থেকে কীভাবে নিশানা স্থির করে গুলি ছুড়তে হয় ইত্যাদি। আলমগীর সাত্তার দক্ষতার সঙ্গে সব প্রশিক্ষণ শেষ করলেন।
প্রশিক্ষণ শেষে আলমগীর সাত্তার অপেক্ষা করতে থাকেন অভিযানে যাওয়ার জন্য। প্রশিক্ষণ স্বল্পমেয়াদি হলেও বিমান নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব। তিনি ডাকোটা বিমান নিয়ে আক্রমণ করবেন। এই বিমান নিয়ে আক্রমণ পরিচালনার জন্য মনোনীত হয়েছেন আরও দুজন—আবদুল মুকিত ও আবদুল খালেক। সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাঁরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে আক্রমণ চালাবেন।
সবকিছু ঠিকঠাক। হঠাৎ তাঁদের মিশন বাতিল হলো। মিশন বাতিল করার কারণ, ওই বিমানে ব্যবহূত জ্বালানি। অকটেন ১০০ এই বিমানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হওয়ায় ইঞ্জিনের পেছন দিয়ে যে ধোঁয়া বের হয়, তাতে অগ্নস্ফুিলিঙ্গের সৃষ্টি করে। রাতের আঁধারে অনেক দূর সেই অগ্নস্ফুিলিঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়। এই অগ্নস্ফুিলিঙ্গের কারণে বিমান শত্রুদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। তাই এই বিমান দিয়ে সামরিক অভিযান বাতিল করা হলো।
ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকায় সামরিক অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে আলমগীর সাত্তার ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অভিযান তিনি করতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি তাঁর ওপর প্রদত্ত অন্য দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। ডাকোটা বিমান পরে মুক্তিবাহিনীর পরিবহন বিমান হিসেবে ব্যবহূত হয়। এ বিমান মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দুর্গম ঘাঁটিতে চলাচল ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী (পরে জেনারেল) এই বিমানে করে বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শনে যেতেন। মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারও (বীর উত্তম, পরে এয়ার ভাইস মার্শাল) দুইবার ওই বিমানে রণাঙ্গন পরিদর্শন করেন। তখন আলমগীর সাত্তার দক্ষতার সঙ্গে বিমান পরিচালনা করে তাঁদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যান।
আলমগীর সাত্তার বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে (পিআইএ) যোগদানের অপেক্ষায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসে ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে যান। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। কিন্তু স্থলযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। পরে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় আলমগীর সাত্তারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩০৫। গেজেটে নাম কাজী আবদুল সাত্তার।
আলমগীর সাত্তারের পৈতৃক বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার গোপালপুর গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায়। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ বিমানের বৈমানিক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর বাবার নাম কাজী আবদুর রউফ, মা নূরজাহান বেগম। তাঁর দুই স্ত্রী; তাহমিনা সাত্তার ও সাইদা সাত্তার। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। তাঁদের দুই মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক, রাফিয়া চৌধুরী এবং একাত্তরের যুদ্ধে বিমানবাহিনী, শ জামান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.