চারদিক-বৃষ্টিভেজা পানাম নগরে by শারমিন নাহার

বাংলা দেশের বর্ষা বলে কথা। সেই ছোটগল্পের মতো শেষ হইয়াও হইল না শেষ। আশ্বিনের প্রথম দিনকেও তাই মনে হচ্ছিল এ যেন ভরা বর্ষা। আগের রাতের শুরু হওয়া ঝুম বৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো ভ্রমণের আগে এমন বৃষ্টি তো যাত্রার জন্য শুভ। তবে সকাল অবধি টানা বৃষ্টিতে যখন ঘর থেকে বাইরে পা ফেলা বিড়ম্বনার,


তখন আর এই বৃষ্টিকে সহসা বিবেচনা করা যাচ্ছিল না। তবে যেই কথা সেই কাজ। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বন্ধুরা সদলে যাত্রা শুরু করলাম ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ে। সোনারগাঁয়ে যখন পৌঁছাই তখন ঘড়ির কাঁটা তিনের ঘর ছুঁয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে পা রাখলে প্রথমেই সামনে পড়ে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। বন্ধুরা হুমড়ি খেয়েই ঢুকল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। আমিও শামিল হলাম বন্ধুদের সঙ্গে। শানবাঁধানো ঘাট আর ঘাটের পাশে বাঁধা ঘোড়া দুটোকে মনে হচ্ছিল জীবন্ত। শুরু হয়েছে গুঁড়ি বৃষ্টি। তাতে কী এসে যায়। চলছে বন্ধুদের ছবি তোলার ধুম। ঘুরে ঘুরে দেখছি বারো ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁর রাজধানী। চোখ ফেরানো যায় না, যতই দেখি মুগ্ধ হই। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত সরে যায় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। তাই আর তর সইছিল না। ঢাকা ফেরার আগে পানাম নগর না দেখলে কি চলে? গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পানাম নগরের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম। সেকালে সোনারগাঁয়ের তিনটি নগর—বড় নগর, খাস নগর আর পানাম নগর। তবে এই তিন নগরের মধ্যে পানাম নগর ছিল সবচেয়ে সুন্দর। এখানে আছে বহু শতাব্দীর পুরোনো ভবন যা ইতিহাসের সেই বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই শহর বিস্তৃত। পানাম নগরে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। বৃষ্টি তখনো হচ্ছে। তার পরেও সারা রাতের ঝুম বৃষ্টিতে পানাম নগরকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য নেয়ে উঠেছে। যেন আরও সিন্ধ, আরও রূপবতী হয়ে উঠেছে। ভাঙা ভবনের জীর্ণতা একটু খানিও ম্লান করে দেয়নি এই ঐতিহ্যবাহী নগরের প্রাচুর্যকে। রিকশা দিয়ে যেতে যেতে ভাঙা ভবনের দিকে যখন তাকাই, তখন মনে হচ্ছিল এক লহমায় পৌঁছে গেছি সেই সময়ে। আর আশপাশের সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। রিকশা ছেড়ে হাঁটতে থাকি। ছুঁয়ে দেখি ভাঙা ভবনের দেয়াল। তবে আমার চৈতন্য তখনই আসে, যখন দেখি না ভবনের ওপরের অংশে লেখা ‘কাশীনাথ ভবন ১৩০৫’ অর্থাৎ ২০১১ইং কিংবা বাংলা ১৪১৮ সালে এসে তো ১৩০৫-এর সঙ্গে মেলাতে পারি না। কেবল তা-ই নয়, ভাঙা ভবনের কারুকার্য করা সিরামিকের নকশা জানান দেয় ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যের। সময়টা আজ থেকে বহু বছর আগে হলেও তা ছিল জৌলুসময়।
এই ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই দ্রুত ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিলেন ঢাকা থেকে আসা বুলবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পানাম নগরে বহুবার এসেছি। কিন্তু যতবারই আসি নতুনভাবে কী যেন একটা খুঁজে পাই। অনেক ছবি তোলা আছে পানাম নগরের। তবে খারাপ লাগে, ভেঙে যাচ্ছে এই ভবন। আমাদের উচিত এই ঐতিহাসিক শহরকে রক্ষা করা।’
পানাম নগরের জীর্ণ ভবনে কিছুদিন আগেও বসতি ছিল। তবে সংস্কারের নামে ফাঁকা করা হয়েছে ভবনগুলো, তাই যেন খাঁ খাঁ করছে। এমনই এক ভবনে বসবাস করতেন মাজেদা বেগম ও তাঁর পরিবার। মাজেদা বেগম বলেন, ‘বহুত দিন তামাতি থাকছি এই হানে। হাউস কইরে গাছ লাগাইছি। তয় অহন বাড়ি থেইকা বাইর কইরে দিছে, কই থাকুম জানি না। আগেও একবার বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিছে বাড়িঘর ঠিক করবে কইয়ে। কিন্তু ঠিক করে নাই। জানি না আসলে ঠিক করা হইব কি না।’
সোনারগাঁয়ের আমিনপুরের বাসিন্দা আশির ঊর্ধ্ব বয়সী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘এবার এই বাড়িগুলান ঠিক করা দরকার। মেলাবার ঠিক হবে শুনছি কিন্তুু হয় নাই।’
ইচ্ছে ছিল আরও কিছু সময় থাকি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ঢাকা ফিরলাম এক বুক আশা নিয়ে। হয়তো পরে যখন আসব এই নগর সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে। নতুন প্রজন্ম জানবে
বাংলার ইতিহাস। চোখ মেলে দেখবে কতটা আভিজাত্যমণ্ডিত ছিল এই বাংলা। আর এর ব্যবস্থা করতে হবে আমাদেরই।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.