হৃদয়নন্দন বনে-সোনালি সূর্য, চড়ূইয়ের খেলা, ক্ষুধার দর্শন by আলী যাকের

একদিন সাইকেলে করে আশুলিয়ার পথ ধরলাম। পেঁৗছে গেলাম তুরাগ নদের ধারে সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তাটি ত্রিধারায় বিভক্ত হয়েছে। একটি ঢাকা থেকে এসেছে, একটি চলে গেছে আশুলিয়া হয়ে নবীনগর-চন্দ্রা রাস্তার দিকে, আর একটি ঢাকার অদূরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানের পাশ দিয়ে চলে গেছে মিরপুর। নিসর্গ আমার অতি প্রিয় একটি বিষয়।


ভাবলাম, এখনও দুপুর হয়নি, সাইকেল চালিয়ে যদি পেঁৗছে যাওয়া যায় উদ্ভিদ উদ্যানে, তবে হয়তো বৃক্ষরাজির সানি্নধ্যে বাকি দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসা যাবে

রোজ সকালে আমি এখানে এসে বসি, আমার পড়ার টেবিলের পাশে। সামনে বিশাল জানালা। সেই জানালার কোল ঘেঁষে আলসেতে রাখা গাছগাছালির টব। ওই জানালা, ছোট গাছগুলো এবং টবের চারপাশ ঘিরে চড়ূইয়ের কিচিরমিচির আমাকে স্বাগত জানায়। আমি তখন ওদের কিছু আধার খেতে দিই। ওরা দ্বিগুণ উৎসাহে আরও বেশি নাচানাচি করে। এদের মধ্যে অনেকে ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকায়। লেজ ওপরে তুলে ধন্যবাদ জানায় আমাকে। পরের দিন সকালে আমি যখন ওই জানালার ধারে গিয়ে বসি, তখন আবারও ওরা একইভাবে আমার কাছে ছুটে আসে। অব্যক্ত ভাষায় আমরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলি। এ রকম প্রতি সকালেই ঘটে। বস্তুতপক্ষে, আমি যদি কোনো সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, ওরা মহাবিরক্ত হয়ে যায়। তারস্বরে চেঁচামেচি করে। ভাবটা এমন যে, যেন আমায় বলছে, 'আজ কী হলো তোমার? এতক্ষণ ধরে এখানে এসে বসে আছি তোমার জন্য?' আমি দেখি, ওরা যখন ওদের খাবার খায়, উড়ে উড়ে এখান থেকে সেখানে। বাচ্চা চড়ূই মায়ের সামনে এসে ঠোঁট দুটি সম্পূর্ণ খুলে ওপরে তাকায়। মা খাবার ভরে দেয় বাচ্চার হাঁ করা মুখের ভেতরে। আবার অনেক সময় দেখি, খাবারের ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়াও বাধিয়ে দেয়। কিন্তু অতি দ্রুত তারা এই শত্রুতা ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু বনে যায়। মানুষের সঙ্গে এখানেই বোধহয় ওদের তফাত। আমি প্রতি সকালে অভিনিবেশ সহকারে ওদের দেখি। আমি চেষ্টা করি নিদেনপক্ষে একটি হলুদ বক্ষের চড়ূই খুঁজে বের করতে। যে চড়ূই বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিশারদ সেলিম আলীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল পাখি নিয়ে গবেষণা করতে। অনেকদিন ধরেই আমি খুঁজে আসছি এই হলুদ বক্ষবিশিষ্ট চড়ূই, কিন্তু খুঁজে পাইনি এখনও। হতাশ হয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, খালি চোখে বোধহয় এই দুর্লভ পাখি দেখা যায় না, যদি না সেলিম আলীর মতো এক জোড়া বিশেষ চোখ থাকে। তার লেখা ঋধষষ ড়ভ অ ঝঢ়ধৎৎড় ি(একটি চড়ূইয়ের পতন) আমার খুবই প্রিয় গ্রন্থ।
এই একঝাঁক চড়ূইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, তাদের স্বাধীনতা, তাদের শঙ্কাহীন জীবন ইত্যাদি দেখতে দেখতে আমার মনে কিঞ্চিৎ হিংসার উদ্রেক হয়। হায়, আমাদের জীবন যদি এ রকম হতো! যে জীবনে দ্বন্দ্ব নেই, ঘৃণা নেই, স্বার্থপরতা নেই। যে জীবনে প্রতিনিয়তই আমাদের কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে না, কণ্ঠরোধ করা হয় না স্বাধীন-মুক্ত চিন্তার। আমাদের মন পরিপূর্ণ, অজ্ঞানতার অমানিশায়। আমরা কি আজ কোনো কিছুই যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখি? অথচ যুক্তিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে যে বাক্যটি আমি প্রথম শিখেছিলাম, সেটি হচ্ছে 'মানুষ যুক্তিবাদী পশু' (গধহ রং ধ জধঃরড়হধষ অহরসধষ)। এর অর্থ তাহলে তো স্পষ্ট এই দাঁড়ায় যে, যদি আমি যুক্তি-বুদ্ধিকে ত্যাগ করি, তবে কেবল পশুতেই পরিণত হয়ে যাব? এই সহজ কথাটি কি আপাত শিক্ষিত আমরা একবারও ভেবে দেখি? এ জগতে মনে হয় মানুষই একমাত্র জীব, যারা অবলীলায় এবং অসংকোচে পাশবিক আচরণ করে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। এই অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এর অগ্রযাত্রা সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, আমরা অতি সহজেই যুক্তিকে জলাঞ্জলি দিই যখন ব্যক্তিস্বার্থ আমাদের কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এ কথাগুলো বলতে বলতে আমার হৃদয়নন্দন বন হঠাৎ কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ে। মনে হয়, এখনও যখন চারদিকে অনেক আলো, অনেক পাখির গান, অনেক শিশুর কলকাকলি, তখন কেন আমি অকারণে নিজের মনকে ভারাক্রান্ত করছি?
ছেড়ে দিই এসব মন-কেমন-করা কথা। ফিরে যাই হৃদয়ের নিকটে আমার। বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন ঢাকা কিংবা এর পার্শ্ববর্তী রাস্তাগুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল। তখন আমি উত্তরাবাসী ছিলাম। ছুটিছাটার দিনে দিব্যি আমরা বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম বিভিন্ন দিকে। একদিন সাইকেলে করে আশুলিয়ার পথ ধরলাম। পেঁৗছে গেলাম তুরাগ নদের ধারে সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তাটি ত্রিধারায় বিভক্ত হয়েছে। একটি ঢাকা থেকে এসেছে, একটি চলে গেছে আশুলিয়া হয়ে নবীনগর-চন্দ্রা রাস্তার দিকে, আর একটি ঢাকার অদূরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানের পাশ দিয়ে চলে গেছে মিরপুর। নিসর্গ আমার অতি প্রিয় একটি বিষয়। ভাবলাম, এখনও দুপুর হয়নি, সাইকেল চালিয়ে যদি পেঁৗছে যাওয়া যায় উদ্ভিদ উদ্যানে, তবে হয়তো বৃক্ষরাজির সানি্নধ্যে বাকি দিনটা কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসা যাবে। তখনও আমার জানা ছিল না ওই তিন রাস্তার মোড় থেকে কতদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন। রাস্তার নিচেই ফসলের ক্ষেতের পাশে সবুজ ঘাসে মোড়া একটি সমান জায়গায় কিছু বাচ্চা ছেলে খেলাধুলা করছিল। আমি তাদের ডেকে রাস্তার ওপরে তুললাম। তারা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। আমি তাদের প্রশ্ন করি, 'আচ্ছা, এখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন কতদূর, এই পথে গেলে?' তারা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর স্বকীয় ভাষায় জবাব দিল, 'ম্যালা দূর।' আমি জিজ্ঞেস করি, 'ম্যালা মানে কত?' আরেকজন, অপেক্ষাকৃত প্রগল্্ভ ছেলে, আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, 'ম্যালা মানে বুঝেন না? ম্যালা মানে ম্যালা দূর।' আমার মাথায় তখন খেপামি ঢুকে গেছে। আমার জানা দরকার কত এই দূরত্ব, সময়ের মাপে কিংবা কিলোমিটারের মাপে। ফলে আমি আবার বলি, 'ম্যালা দূর তো বুঝলাম। কিন্তু সেটা কত ম্যালা?' তাদের মধ্যে একজন, সবচেয়ে কম বয়সী হবে হয়তোবা, সবাইকে ঠেলেঠুলে দু'পাশে সরিয়ে একেবারে আমার কাছে চলে এলো। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, 'এতদূর যে, যাইতে যাইতে আপনের খিদা লাইগা যাইব।' আমি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কী অকাট্য কথা! ক্ষুধা দিয়ে দূরত্বের পরিমাপ। এই যে মানুষগুলো, যাদের জীবনে ক্ষুধা একটি অত্যন্ত বড় সত্য, তাদের সবকিছুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই দর্শন, যার পরিমাপ করা যায় কেবল ক্ষুধার মাধ্যমেই। এই দর্শন আপাতদৃষ্টিতে কত সহজ, কত প্রত্যক্ষ, কত নিরাভরণ, কিন্তু কত সত্য। এতদূর যে, যেতে যেতে খিদে লেগে যাবে! এর চেয়ে সুন্দর কথা আমি সাম্প্রতিককালে খুব কমই শুনেছি। বড্ড ভালো লাগল ওদের। স্থানটির অদূরেই যে ঘাট রয়েছে, তার পাশে ঝালমুড়িওয়ালা ছিল। আমি তাকে ডেকে বললাম, আমাদের সবাইকে মুড়ি খাওয়ান। তারপর সেই মুড়ি খাওয়া নিয়ে মহা হৈচৈ, অনেক গল্প, সবশেষে ডাংগুলি খেলা। তারপর সূর্য যখন তেতে উঠল, আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হৃষ্ট চিত্তে সাইকেল চড়ে রওনা হলাম
বাড়ির পথে।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.