ঢাকা-চট্টগ্রাম যাত্রীবাহী জাহাজ দরকার-কম খরচে ৭ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে by টিটু দত্ত গুপ্ত

ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। রেল যোগাযোগও উন্নত নয়। ফলে বিদ্যমান সড়কের ওপর পড়ছে অত্যধিক চাপ। হাইওয়ে বলতে যা বোঝায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক তা নয়। ডিভাইডার নেই, রাস্তার ওপর বাজার বসে। যানজটের কারণে যাতায়াতে সময় বেশি লাগে।


ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে জলপথে যাত্রী পরিবহন চালু হলে সড়কের ওপর চাপ কমবে, দুই মহানগরীর মধ্যে যোগাযোগের একটি নিরাপদ ও আরামদায়ক বিকল্পও পাবেন ভ্রমণকারীরা।
বিশেষজ্ঞ, সরকারি নীতিনির্ধারক ও সমুদ্র পরিবহনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে জলপথে পণ্যবাহী কার্গো চলাচল করছে। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে কনটেইনার জাহাজও চলাচল করবে। একইভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একইপথে ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত যাত্রীবাহী জাহাজও চলাচল করতে পারে।
জাহাজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহেল বারী বলেন, জলপথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। জাহাজে ঘণ্টায় ৪৫ কি.মি. বেগে সাত ঘণ্টায় অনায়াসে এই দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব। সড়ক বা রেল কোনো পথেই বর্তমানে এর চেয়ে কম সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যায় না। 'রাত ১০টায় যদি জাহাজ ছাড়ে, তাহলে দিনের কাজ সেরে মানুষ জাহাজে উঠে সারা রাত ঘুমিয়ে সকালে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। দিনের বেলা অফিসের কাজকর্ম সেরে রাতের ফিরতি জাহাজে আবার নিজের জায়গায় চলে আসতে পারবে।'
ড. বারী বলেন, সড়ক পথে সব দিক থেকেই ব্যয় বেশি। নতুন সড়ক তৈরি বা প্রশস্ত করা, মেরামত করে চলাচলের উপযোগী রাখার জন্য বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয় সরকারের। বাস, ট্রাকসহ সব ধরনের গাড়ি এবং এগুলোর জ্বালানি আমদানি করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে। অন্যদিকে, সব ধরনের নৌযান দেশেই তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বমানের সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি করে ইউরোপে রপ্তানি করছে।
জলপথে চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে ১০ কিলোমিটারের মতো পথ সমুদ্র উপকূল ধরে আসতে হয়। তাই যাত্রী পরিবহনের জন্য কোস্টাল শিপ দরকার। ৪০০ ফুটের একটি কোস্টাল শিপ অন্তত ২০০টি জাহাজ ও ১০০টি বড় বাসের সমান পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম। জ্বালানি লাগবে তিন ভাগের এক ভাগ। তা ছাড়া এ জাহাজ দেশেই তৈরি করা যাবে। এ ধরনের জাহাজ সদরঘাট টার্মিনালেই ভিড়তে পারবে, তবে যাত্রী চলাচলের সুবিধার জন্য এখানকার ব্যবস্থাপনা একটু উন্নত করতে হবে।
ড. বারী জানান, এ রকম দুটো জাহাজ দিয়েই যাত্রী পরিবহন চালু করা যায়। দুটো জাহাজ বানাতে খরচ পড়বে ৬০০ কোটি টাকা। ১০ বছরেই বাস-ট্রাক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে, আর একটি জাহাজের গড় আয়ুষ্কাল ৫০ বছর। ৩০ বছরে তেমন কোনো মেরামতও লাগে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়া-আসায় একটি জাহাজে ডিজেল লাগবে ২৫ টন, আর এর সমপরিমাণ যাত্রী ও মালামাল বহনের জন্য বাস ও ট্রাকে জ্বালানি লাগবে এর তিন গুণ।
ট্রাকগুলো ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মালামাল বহন করে। এর চাপ পড়ে রাস্তার ওপর, মেরামত খরচ বেড়ে যায়। রাস্তা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাস-ট্রাক ও জ্বালানির আমদানি খরচ দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় চাপ সৃষ্টি করে। ড. বারীর মতে, এ চাপের অনেকটাই লাঘব করা সম্ভব জলপথে পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। জাহাজে ভ্রমণ সড়ক পথের চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক ও নিরাপদ।
একই মত পোষণ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। 'ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে জলপথে যদি পণ্য পরিবহন চলতে পারে, তাহলে যাত্রী পরিবহন নয় কেন? ভ্রমণকারীদের, বিশেষ করে যারা বেড়াতে যাবেন, বা যাদের খুব তাড়াহুড়ো নেই, তাদের জন্য এর চেয়ে আরামদায়ক বাহন আর হতে পারে না।'
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের আরামদায়ক ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য ৮০ ফুট দীর্ঘ ডাবল-হল ক্রুজ লাইনার চালু করা যেতে পারে বলে মনে করেন ড. রফিক। পর্যটকদের কাছে এ ধরনের জলযান দ্রুত জনপ্রিয় হবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
'কার্গো ভেসেল আসছে, কনটেইনার ভেসেল চলবে, প্যাসেঞ্জার ভেসেলও অবশ্যই চলতে পারবে। সড়কের চেয়ে রেলপথ আরামদায়ক। এর চেয়েও আরামদায়ক জলপথে ভ্রমণ।'
রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারীদের হিসাবে, ২০০ ফুটের একটি বিলাসবহুল ক্রুজ লাইনার তৈরির খরচ পড়বে প্রায় ১০ কোটি ডলার (প্রায় ৮০০ কোটি টাকা)। আর কোস্টাল পথ পাড়ি দিতে সক্ষম ৮০ ফুট দীর্ঘ নিরাপদ যাত্রীবাহী নৌযানের খরচ পড়বে ৭০ লাখ ডলার (প্রায় ৫৬ কোটি টাকা)।
রাজধানী ও বন্দর নগরীর মধ্যে জলপথে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা যে অসম্ভব নয়, তা বিশ্বাস করেন জাহাজ পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ও হাইস্পিড গ্রুপ অব কম্পানিজের চেয়ারম্যান কে এম মাহমুদুর রহমান বলেন, 'কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে কনটেইনার জাহাজ চলাচল শুরু করবে। কার্গো ভেসেল আগে থেকেই চলছে। এ দুই নগরীর মধ্যে নৌপথে যাত্রী পরিবহনও নিশ্চয়ই সম্ভব। সরকার আগ্রহী হলে আমরাও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসব।'
এ বিষয়ে সরকারেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বলে জানালেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেন, 'আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। আমরা প্রাইভেট সেক্টরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছি না।'
নৌপরিবহনে জড়িত ব্যক্তি খাতের অনেকের সঙ্গে এ ব্যাপারে তিনি বৈঠক করেছেন বলে মন্ত্রী জানান। ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌপথে যাত্রী পরিবহনের ব্যাপারে একবার একটি ব্রিটিশ জাহাজ কম্পানি আগ্রহ দেখালেও পরে আর যোগাযোগ করেনি। বরিশালের একটি বড় নৌপরিবহনের মালিক ও চেম্বার নেতার সঙ্গেও এ ব্যাপারে তাঁর আলাপ হয়েছিল। তিনি রুট পারমিট চেয়েছিলেন। আমি বলেছি, 'পারলে আপনারা ২০টি প্যাসেঞ্জার ভেসেল নামান, রুট পারমিট আমরা দিয়ে দিচ্ছি।'
ঢাকা-চট্টগ্রামে নৌপথে যাত্রী পরিবহন লাভজনক হবে বলে বিশ্বাস করলেও সরকারের পক্ষে জাহাজ নামানো কঠিন বলে জানান নৌপরিবহন মন্ত্রী। 'আমাদের দুটি স্যালভেজ শিপ কিনতে হচ্ছে, মাদার ট্যাংকার কিনছি, ওয়াটার বাস, ফেরি বানাতে হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে নৌপথে যাত্রী পরিবহনে বেসরকারি খাত এগিয়ে এলে খুশি হতাম। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।'

No comments

Powered by Blogger.