ধর্ম-ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা ও বিশ্বস্ততা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য জীবিকার প্রয়োজন। আর জীবনধারণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ বা রিযিক। জীবনোপকরণের পর্যাপ্ত প্রাপ্তি জীবনকে উপভোগ্য ও ছন্দময় করে। মানবসমাজে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবিকার্জনের যেসব মাধ্যম আছে তার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বোত্তম পন্থা।


একজন মুসলমান হালাল রিযিক অর্জনের জন্য যেমন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে তেমনি হারাম বর্জনের জন্যও সদাসতর্ক থাকবে। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় জীবনোপকরণ অর্জনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাকে ফরজ ইবাদত হিসেবে গণ্য করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫)
জীবিকার্জনের মূলধারাকে ইসলাম সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে দিয়েছে; জীবন ও জীবিকার আবর্তে মানুষ যাতে তার মানবিক গুণাবলি বিসর্জন দিয়ে অমানুষে পরিণত না হয়। কেননা মুমিনের জীবনের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের জীবিকা অর্জনের বিশেষ উপায় ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় এবং সাংসারিক জীবনের কর্মব্যস্ততা তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে ফিরিয়ে রাখে না বা নানা প্রকার পার্থিব কর্মকাণ্ড তাদেরকে আল্লাহর ইবাদতে বাধাগ্রস্ত করে না। বিশ্বস্ত সৎ ব্যবসায়ীদের গুণাবলি ও উচ্চতর মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা এমন লোক (ব্যবসায়ী) যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, সালাত কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। পরিণামে তাদের সৎকাজের জন্য আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দিবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দিবেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।’ (সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩৭-৩৮)
সাহাবায়ে কিরাম ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন এবং তাঁদের মধ্যে সৎগুণাবলি পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। ব্যবসা পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষের বিবিধ উপকার সাধন করেছেন। তাঁরা ব্যবসার স্থানে থেকেও ইবাদতের কোনো কমতি করেননি। এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা সৎ, বিশ্বস্ত ও ইবাদতকারী। যেকোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য বা জিনিস সঠিকভাবে মেপে দেওয়া বা এতে কোনোরকম কমবেশি না হওয়া ব্যবসায়ীদের সততা ও বিশ্বস্ততার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্ট।’ (সূরা বনি-ইসরাঈল, আয়াত: ৩৫)
যে ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য বা উপার্জনের ব্যতিব্যস্ততার মধ্যেও নিজের অন্তরকে আল্লাহর স্মরণে নিবদ্ধ রাখতে পারেন, তাঁর পক্ষে উপার্জনে প্রবৃত্ত হওয়া খুবই উত্তম। যিনি কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর সঙ্গে অন্তরকে সংযুক্ত রাখতে পারেন, তিনিই প্রশংসনীয়। তাই সৎ, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ীরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে খুবই প্রিয় ও পছন্দনীয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদানদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিযী)
রাসূলুল্লাহ (সা.) সৎ ব্যবসায়ীদের শহীদি মর্যাদায় ভূষিত করে ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ত্যাগ স্বীকার করে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় মুসলিম জনপদে কোনো প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করেন এবং ন্যায্য মূল্যে তা বিক্রয় করেন তখন আল্লাহর কাছে তিনি শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।’
যেকোনো প্রকার পণ্যদ্রব্য বা জিনিসে ভেজালদানকারী অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্রয়-বিক্রয়ের সময় বিক্রেতাকে বলতেন, ‘মূল্যের হিসাব অনুযায়ী ওজন করো, বরং একটু বেশি করে মেপে দাও।’ অসৎ ও মিথ্যাবাদী ব্যবসায়ীদের অপকর্মের পরিধি খুবই ব্যাপক। অনেকে খাদ্যদ্রব্য বা জিনিসপত্র মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় মেপে নেয় ও ওজন করার সময়ও সঠিকভাবে ওজন করে নেয়; কিন্তু দেওয়ার বেলায় মাপে কম দেয় এবং ওজন করার সময় ওজনে কম দেয়। আবার কারও বদঅভ্যাস খাদ্যে ভেজাল প্রয়োগ করা। যেসব খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের জীবনীশক্তি অর্জিত হয় এবং দেহ সুস্থ থাকে, সেসব খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া মানে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। এদের ভয়ানক শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পরিমাপ ও ওজনে যারা কম করে তাদের জন্য ধ্বংস নির্ধারিত। তারা যখন লোকদের থেকে নিজেদের প্রাপ্য নেয় তখন পুরোপুরি নেয় এবং যখন লোকদেরকে পরিমাপ বা ওজন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি বিশ্বাস করে না যে, একটি কঠিন দিবসে তাদেরকে জীবিত করে ওঠানো হবে? সেদিন সমগ্র মানবজাতি বিশ্বজাহানের প্রভুর সামনে দাঁড়াবে।’ (সূরা আল-মুতাফফিকীন, আয়াত: ১-৬)
ইসলামে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে অসাধু পন্থা অবলম্বনের পথ চিরতরে বন্ধ ঘোষণার পরও যারা অবৈধ পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করে তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা ঘোষিত হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন অসাধু ব্যবসায়ীরা গুনাহগারদের কাতারে উত্থিত হবে।’ (তিরমিযী)
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘কোনো ব্যক্তি লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে আগুনের হাড়ের ওপর বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ পণ্যের দোষ গোপন করা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দোষযুক্ত পণ্য বিক্রি করে, ক্রেতাকে দোষের কথা জানায় না, এমন ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহর ঘৃণার মধ্যে থাকবে এবং ফেরেশতারা সর্বদা তাকে অভিশম্পাত দেবে।’
ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়া, পণ্যের দোষ গোপন করা, কৃত্রিম মুদ্রা চালিয়ে দেওয়াসহ সকল প্রকার অসাধু ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসা ও কর্ম একটি জঘন্যতম অপরাধ ও মহাপাপ। যে ব্যক্তি অন্যকে মেপে দেওয়ার জন্য এক প্রকার এবং নিজে মেপে পাওয়ার উদ্দেশ্যে অন্য প্রকার বাটখারা ব্যবহার করে, সে ব্যক্তি সর্বপ্রকারের পাপিষ্ঠ অপেক্ষা অধিকতর মহাপাপী। ইসলামে এ ধরনের কাজ হারাম। অসাধু ব্যবসায়ীদের সাবধান করে দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যবসায়ী ধোঁকাবাজি করবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)
ইসলামে ব্যবসায়িক অসাধুতার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি, মজুদদারি, কালোবাজারি, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কারচুপি করা, নকল করা; ধোঁকা, প্রতারণা ও ঠকবাজির আশ্রয় নেওয়া; দামে হেরফের করা প্রভৃতি অসাধুতার পথ ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ। তাই আসুন, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মেনে চলি। সুদ, ঘুষ, মুনাফাখোরি, মজুদদারি, ফটকাবাজারি ও কালোবাজারিসহ সব ধরনের অবৈধ পন্থায় অর্থোপার্জন থেকে বিরত থাকি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.