আর কত হিমুকে আমরা হারাব? by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

চট্টগ্রামে হিমু হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিককালে কিশোর অপরাধপ্রবণতার মাত্রাকে এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে বলে সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত। হত্যাকাণ্ডটি শুধু নির্মমই নয়, মর্মস্পর্শীও বটে। হিমুকে হত্যা করার কৌশলগুলো আমাদের অপরাধ জগতে এক নতুনমাত্রা যোগ করেছে।


পোষা কুকুর দিয়ে হিমুর ওপর আক্রমণ, অতঃপর ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া- আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি নতুন কৌশল হিসেবে অভিহিত করা যায়। দীর্ঘ ২৭ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেল হিমু। দেশের অত্যন্ত মেধাবী এক ছাত্র, মা-বাবার আদরের এক সন্তান, যে হতে পারত দেশের কাণ্ডারি, ভবিষ্যৎ কর্ণধার- তার বিদায় হলো। মাঝেমধ্যে আমরা এ রকম লোমহর্ষক ঘটনা লক্ষ করি। আমাদের শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে যখন পত্রপত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে এ ধরনের সংবাদ দেখি। এ ধরনের ঘটনায় সংবাদকর্মী, মানবাধিকার সংস্থাসহ আমরা কিছুদিন হৈচৈ করি। পরক্ষণে সব ভুলে যাই। আবার একটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা করি।
কিশোর কর্তৃক কিশোর হত্যা নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত আমরা কমবেশি এ ধরনের ঘটনা লক্ষ করি। শুধু কিশোর কর্তৃক কিশোরই নয়, বয়স্ক কর্তৃক কিশোর-কিশোরীদের হত্যাও বেশ লক্ষণীয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কারণ ও প্রেক্ষাপট কিশোরদের অপরাধের তুলনায় একটু ভিন্ন। পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কিংবা বিকৃত যৌন লালসা, আবার কখনো বা দ্রুত আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য অপহরণের মাধ্যমে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেশি পরিমাণে ঘটে। কিন্তু একই বয়সের দুই বা ততোধিক কিশোরের মধ্যে যখন হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন এর কারণ ও প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ কথা অনস্বীকার্য যে কোনো ব্যক্তিই অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কথাটি সাদামাটা এবং এ নিয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করবেন না। কিন্তু যাঁরা অপরাধ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং এখনো করছেন, তাঁরা সাদামাটা ও প্রচলিত সত্যকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করতে নারাজ। তাঁরা যা-ই বলুন না কেন, এ কথা মিথ্যা নয় যে সমাজে বসবাস করার মধ্য দিয়ে মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে জন্মগত কিছু অপরাধ বৈশিষ্ট্য হয়তো থাকে, যা তাদের অপরাধপ্রবণ হওয়ার পক্ষে কাজ করে। মোদ্দা কথা, অপরাধের আর্থ-মনো-সামাজিক কারণ অন্যান্য কারণের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকে এ মত পোষণ করেন যে অপরাধের কারণগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ফ্রেমে বাঁধা কঠিন। ব্যক্তি নিজে কিংবা তাকে কেন্দ্র করে যে আবহ তৈরি হয়, সে জন্য কারণগুলো ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। কোনো সমাজেই একই ধরনের মানুষ অপরাধ করে, এমনটি ঠিক নয়। কিশোরদের বেলায়ও এটি সত্য। আমরা একদিকে যেমন নিম্ন-আয়ের পরিবারের কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা লক্ষ করি, আবার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারেও এ প্রবণতা বিদ্যমান। তবে সংখ্যার বিচারে এর হার কমবেশি হতে পারে। ফলে কিশোর অপরাধপ্রবণতাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক- এ ত্রিমাত্রায় চিন্তা করাটা বেশি উপযোগী।
কিশোর কর্তৃক সংঘটিত লোমহর্ষক ঘটনাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে একধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ভুল হবে না যে প্রতিটি ঘটনা একটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। কখনো কোনো কারণ, আবার নিতান্ত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে। কখনো কখনো পূর্বপরিকল্পনা, আবার কখনো বা আকস্মিকভাবে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। হিমু হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত এবং এর কারণ একটু ভিন্ন। গতানুগতিক অবস্থা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির ছেলে ছিল হিমু। প্রতিবাদ ছিল স্থানীয় মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে। একটি টিভি চ্যালেনের সংবাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়। অবশ্য কালের কণ্ঠের এক সংবাদে জানা যায়, অভিযুক্ত অপরাধী রিয়াদের বাবা সম্পর্কে ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করাকে কেন্দ্র করে হিমুকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম কারণটি সঠিক ধরে নিলে তরুণ বয়সে এ ধরনের প্রতিবাদ আমরা কম লক্ষ করি। তার সমবয়সী অনেকে যেখানে মাদকে ডুবে থাকছে কিংবা মাদক গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত নয়, তখন হিমু গতানুগতিক ধারায় ভিন্ন এক নক্ষত্র। তাকে সাহায্য বা উৎসাহ দেওয়ার কেউ ছিল না বিধায় হয়তো প্রতিপক্ষ তাকে হত্যা করতে সাহস পেয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে মাদকের মরণ নেশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো মেধাবী হিমুকে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বহুমাত্রিক প্রাথমিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে পরিবার ও বিদ্যালয় অন্যতম। এরপর রয়েছে সামাজিক সংগঠন ও আইন। ধর্মের প্রয়োগও কম নয়। প্রতিটি মাধ্যমই কমবেশি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। কোনোটির গুরুত্ব একেবারে কম নয়, আবার একটিই সর্বেসবা- তা বলাও উচিত নয়। ধরুন, আমরা একমাত্র আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকর্মটি সম্পন্ন করতে চাই। কিন্তু সম্ভব কি? দেশে অনেক আইন বলবৎ রয়েছে, কিছু অপরাধ করা থেকে মানুষ কি দূরে সরে যাচ্ছে? উত্তর, অবশ্য না। আইন একটি ভূমিকা পালন করতে পারে মাত্র, কিন্তু পুরোটা নয়। সে জন্য আইনের পাশাপাশি প্রচলিত বিচারপ্রক্রিয়ার ধাপগুলোর বাইরে এসে প্রতিরোধধর্মী মানসিকতার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক মাধ্যমগুলোকে গতিশীল করার প্রতি জোর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থায় থেকেও পুলিশদের নিজেদের ভূমিকার ভেতর কিছুটা পরিবর্তন এনে কঠোরভাবে দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সাফল্য পাওয়া যেতে পারে।
আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন ইন্টারনেট, মোবাইল ও ফেসবুকনির্ভর এ সমাজে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে পরিবার ও বিদ্যালয় ব্যবস্থার ভূমিকা কতটুকু কার্যকর ও টেকসই, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। বিদ্যমান শিক্ষা ও পরিবার ব্যবস্থার কাঠামোগত ও গুণগত পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু গণ্ডির মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সীমাবদ্ধ রাখার ফলে পরিপূর্ণ বিকাশটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আধুনিক জগতের নতুন নতুন সৃষ্টি জানা তাদের জন্য সহজ হচ্ছে; কিন্তু অনেকে জানতে পারছে না নিজস্ব মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ডগুলো। আবার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের কড়া শাসন এখন আর অভিভাবকরা সহজে মেনে নিতে পারেন নাা। ফলে বিভিন্ন শিক্ষণীয় জগতের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা পরিচিত হচ্ছে বটে, কিন্তু যে বিষয়গুলো তার আবেগ ও অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, নিজের মধ্যে নতুন উদ্যম জাগ্রত করতে পারে, একটি মিশন ও ভিশন সামনে দেখাতে পারে- এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মতো চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া তাদের মধ্যে বিরল। তারা ভিন্ন একটি জগতে বড় হচ্ছে, যেটি সত্যিকারভাবে আংশিক। হিমুর মতো অনেকে হয়তো রয়েছে; কিন্তু অন্যদের পাল্লা কম ভারী নয়। পরিবার থেকে যখন ভালো সেবা না পায়; বরং পারিবারিক কাঠামো তাকে উৎসাহী করে তখন বিচ্যুত আচরণ করাই স্বাভাবিক। হিমুর হত্যাকারীরা সে রকম হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা চাইব হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি। আর মাদকের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি। নইলে মেধাবী হিমুদের এভাবে জীবন দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.