দেশহীন মানুষের কথা-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয়, আদিবাসীরা আত্মপরিচয়ে মানুষ by সঞ্জীব দ্রং

বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী (অব.) মহোদয়কে তাঁর আদিবাসী নাম-বিতর্ক লেখাটির জন্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। লেখাটি প্রথম আলোয় ২৫ জুন ছাপা হয়েছে। বলতে গেলে, জোরালো ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে তিনি আদিবাসী বিতর্ক যাঁরা নতুন করে তুলেছেন, তাঁদের জবাব দিয়েছেন।


আমরা আশা করব, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বলে নতুন শব্দ যাঁরা আমদানি করেছেন, তাঁরা চুপ না থেকে রাব্বানী সাহেবের লেখার জবাব দেবেন।
সরকার ‘বাহাদুর’ নতুন একটি আইন বানিয়েছে আদিবাসীদের জন্য, তাদের উপকারের জন্য। কিন্তু আদিবাসীদের ‘প্রকৃত’ মতামত নেওয়া হয়নি। তারা আমাদের কাউকে ডাকেনি। আমরা বিনম্রচিত্তে বিনা পারিশ্রমিকে সরকারকে একটু সহযোগিতা করতে পারতাম। সরকার ডেকেছে কয়েকজন অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীকে। তাঁদের চারজনের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁরা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ শব্দটি সমর্থন করেননি; বরং বলেছিলেন আদিবাসী শব্দটি রাখতে। এগুলো মৌখিক কথাবার্তা, আমি তো রেকর্ড করে রাখিনি। এ যুগে মানুষের মুখের কথার দাম নেই, কী অদ্ভুত ব্যাপার। অথচ মুখের কথাকে বিশ্বাস ও সম্মান করে হাজার বছর টিকে ছিল আদিবাসী জগৎ। মানুষ মানুষকে সম্মান করত, চালাকি আর পোশাকি কারবার ছিল না। অথচ আমরা দেখছি, কাগুজে সভ্যতা ও উন্নয়নের কী ভয়াবহ ও করুণ পরিণতি এখন।
বিলটি আসলে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল। এতে আদিবাসীদের বঞ্চনা, ভূমি হারানো, প্রান্তিকতা, অপমান, দুঃখ-কষ্ট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনো উন্নতি হবে না। তবে এই আইনের ফলে আদিবাসী কর্মচারীরা উপকৃত হবেন। প্রতিষ্ঠানগুলোও একটি ধারার মধ্যে আসবে। সব মিলিয়ে যে কয়টি ‘উপজাতীয়’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আছে—যেমন, রাঙামাটি, বিরিশিরি, বান্দরবান ইত্যাদি—এগুলোর জন্য বিলটি ভালো হবে। আমি শুনেছি, আদিবাসী কর্মকর্তারাও বেশ খুশি। কিন্তু আরও তো ভালো করা যেত এবং এত আদিবাসী বাদ পড়ত না। এখন সরকার ‘ভালো’ করতে গিয়ে বাদ পড়া আদিবাসীদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই আইনটি এখন ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনসহ সরকারের কিছু কাগজপত্র এবং আদমশুমারির তালিকার সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। এতে প্রায় ২০টি আদিবাসী যা সরকারি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সরাসরি বঞ্চিত হয়েছে। বিলটি পাস হওয়া এবং আইনে পরিণত হওয়ার খবর আমরা কেউ জানতাম না।
আমাকে ফোন করেছেন সিরাজগঞ্জের একজন মাননীয় সংসদ সদস্য। তিনি সরকারদলীয়। তাঁর কাছে মাহাতো ও অন্যান্য আদিবাসীরা দল বেঁধে গিয়েছে। তাঁর ফোন পেয়ে আমি খুশি হয়েছি। তিনি কিছু পরামর্শ চাইলেন। মাহাতোরা তাঁকে বলেছে, আপনি থাকতে এ রকম কেন হলো? এ বিলে কেন মাহাতোসহ অনেক আদিবাসী বাদ পড়ল? পরে এই সংসদ সদস্য তাঁর প্যাডে চিঠি লিখেছেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রীকে, যেখানে তিনি তাঁর অঞ্চলের আরও ১৪টি আদিবাসীকে যুক্ত করেছেন। এর আগে উত্তরবঙ্গের নওগাঁর আরেকজন সংসদ সদস্য কোল ও মুন্ডা সম্প্রদায়কে যুক্ত করেছেন এবং এটি গৃহীত হয়েছে। কাজটি তিনি ভালো করেছেন।
অনেকে বলছেন, আইন তো সংশোধন করা যায়। ঠিক আছে, তবে সংশোধন করেন। কিন্তু কবে হবে সেটা? বিলটির নামকরণ ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এটিকে কেন আদিবাসী বলা হবে এবং আদিবাসী বললে যে রাষ্ট্র বা সরকারের বা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কোনো সমস্যা হবে না, এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। সহজভাবে বলতে হবে যে এই মুন্ডা-সাঁওতাল-গারো-হাজং-চাকমা-মারমা মানুষেরা বহুকাল ধরে নিজেদের আদিবাসী পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে আসছে এবং নিজেরা এ শব্দ ব্যবহার করছে। পাশাপাশি বাঙালি সমাজও বহুকাল ধরে তাদের আদিবাসীই বলে আসছে। এ বিষয়ে আপনারা বইপত্র দেখতে পারেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও (আগে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন) তাদের আদিবাসীই বলেছেন, বাণী দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দুবার—২০০০ ও ২০০৯ সালে এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে কয়েকবার ‘আদিবাসী’ হিসেবেই বাণী দিয়েছেন। অনেক মন্ত্রী এখনো এবং আগেও আদিবাসী হিসেবে বহুবার বহু জায়গায়, এমনকি টিভিতে বক্তব্য দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী বলা হয়েছে। গত বছরের বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনেও ‘আদিবাসী’ বলা হয়েছে; এবারও তিনি ‘আদিবাসী’ শব্দ বাজেট উপস্থাপনের সময় ব্যবহার করেছেন। তবে লিখিত আকারে আছে, সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায় শব্দগুলো। তা ছাড়া পুরোনো বেশ কয়েকটি আইনে আদিবাসী শব্দ আছে। আইএলও কনভেনশনের ১০৭ সনদে আদিবাসীরা আছে, যা সরকার র‌্যাটিফাই করেছে। এমনটি ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের আদিবাসী বলা হয়েছে। ‘উপজাতি’ শব্দটিও ব্যবহূত হয়েছে বহুবার বহু বছর। কিন্তু এখন তো আমরা এই শব্দ কেউ ব্যবহার করছি না, কেননা আদিবাসীরা এটি পছন্দ করে না। আদিবাসীরা যদি না চায়, অন্যরা কেন এটি ব্যবহার করবে?
‘আদিবাসী’ মানে কে পৃথিবীতে প্রথম এসেছে, তা নয়। এই প্রশ্নের উত্তর কি মিলেছে, সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য? আদিবাসী কথাটার মূল বক্তব্য হলো, প্রান্তিকতা এবং ঔপনিবেশিক কাল ও আধুনিক বা জাতিরাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে তাদের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনা এবং রাষ্ট্র গঠন-প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃত্ত না করা; বরং উল্টো তাদের ওপর সীমাহীন শোষণ ও নিপীড়ন চালানো এবং তাদের অধীনস্থ করা। আদিবাসীরা মূলত শাসিত। তাই বিশ্বব্যাপী আদিবাসী সমাজ মানেই চরম শোষিত এক অসহায় দরিদ্র মানুষ, যারা তাদের নিজ বাসভূমি শুধু নয়, পুরো অঞ্চল ও জগৎ হারিয়েছে। সুতরাং আদিবাসী শব্দটি বুঝতে গেলে রাষ্ট্রকে এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত জানতে হবে, মানতে হবে। না মেনে নিশ্চয় থাকা যায়, কিন্তু সেটি কি সম্মানীয় কাজ হবে? পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র যারা জাতিসংঘের সদস্য, আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করেছে। আমরা শুনেছি, কেউ বলছেন, আদিবাসী বললে ক্ষতি বা ঝামেলা হবে? আমি এর উত্তর জানি না। সেই ব্রিটিশ সময় থেকে আদিবাসী শব্দটি চলে আসছে, ওপরে অনেক উদাহরণ দিলাম; অন্যদের ক্ষতি ও ঝামেলা তো দূরে থাক, আদিবাসীরাই দিনে দিনে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আর এই শব্দের কারণে কী ক্ষতি হয়েছে, কেউ বলবেন কি? এ নিয়ে আরও দীর্ঘ আলোচনা করতে পারতাম।
এই মুহূর্তে শুধু সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, বিলের নাম পরিবর্তন না হলেও যেহেতু তফসিলে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকা আছে, সেটি বাড়িয়ে মাহাতো, সিং, মাহালী, বানাই, হদি, বড়াইক, মালোসহ কমপক্ষে ৪৫টি করা হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই আদিবাসী দিবসের বাণীতে দেশের ৪৫টি আদিবাসীর কথা বলেছিলেন। এখন কেন অন্যদের বঞ্চিত করে আদিবাসীর সংখ্যা কমানো হলো?
সবচেয়ে ভালো হতো যদি বলতে পারতাম, আমরা সবাই মানুষ, সবার অধিকার ও মর্যাদা মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে সমান? কিন্তু সমাজে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, এমনকি নারী-পুরুষভেদে প্রবল বৈষম্য বিদ্যমান। যেদিন এসব মানবসৃষ্ট বৈষম্য দূর হবে, সেদিন আদিবাসী পরিচয়ের এই বিতর্ক নিশ্চয় আর থাকবে না?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.