সম্পাদকের কলাম-সাংবাদিকদের ওপর এত আক্রোশ কেন? by ইমদাদুল হক মিলন

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে চিলেকোঠার ছায়ায় বসে আছেন বঙ্গবন্ধু। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা। এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে পা তুলে দিয়েছেন। হাতে প্রিয় পাইপ। এরিন মোরের গন্ধে উতলা হয়েছে ছাদের হাওয়া। এ সময় একটি ছেলে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ছাদে এলো। তার হাতে ক্যামেরা। সে ক্লিক ক্লিক করে বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে লাগল।


বঙ্গবন্ধু গম্ভীর মুখে ছেলেটির দিকে তাকালেন। ১৯৭৩ সালের কথা। বললেন, এই, তুই কে রে?
আমার নাম পাভেল, পাভেল রহমান।
কী করিস?
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ছবি তোলা আমার হবি।
তুই কি জানিস তুই কার ছবি তুলছিস?
জানি। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলছি।
আমি যে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এটা তুই
জানিস?
জানি।
প্রেসিডেন্টের পারমিশন ছাড়া যে তাঁর ছবি তোলা যায় না, জানিস?
পাভেল চুপ করে রইল।
বঙ্গবন্ধু সিকিউরিটি ডাকলেন। 'এই ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে রাখ। আমি আসছি।'
সিকিউরিটির লোকজন পাভেলকে দাঁড় করিয়ে রাখল। বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে গেলেন। ভয়ে পাভেলের তখন বুক শুকিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু আবার ছাদে এলেন। তাঁর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি আর বিখ্যাত মুজিব কোট। হাতে যথারীতি পাইপ। ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি পাভেলকে বললেন, 'এবার আমার ছবি তোল।'
পাভেলের ভয় কেটে গেল। গভীর উৎসাহে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি ছবি তুলল সে। একসময় বঙ্গবন্ধু একজন সিকিউরিটির লোককে দেখিয়ে বললেন, 'ওর হাতে ক্যামেরা দিয়ে তুই আমার পাশে এসে দাঁড়া।' পাভেল বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু তার কাঁধে হাত রাখলেন। সিকিউরিটির লোককে বললেন, 'ওর সঙ্গে আমার ছবি তুলে দাও।'
পাভেলকে খুবই স্নেহ করতেন শেখ কামাল। শেখ কামালের জন্যই যখন-তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করতে পারত সে। তারপর দিনে দিনে বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক হয়ে উঠল পাভেল। কত বিখ্যাত ছবি তার। আমেরিকা, ব্রাজিল, রকম কত দেশ থেকে ফটোগ্রাফিতে আন্তর্জাতিক এবং বহু সম্মানীয় পুরস্কার পেয়েছে। পাভেলের ছবি 'চাঁদের গাড়ি' দিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত সাপ্তাহিক 'নিউজ উইক' প্রচ্ছদ করেছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ছবি দিয়ে করেছিল। অন্য কোনো বাঙালি ফটো সাংবাদিকের ভাগ্যে এ ধরনের সম্মান জুটেছে বলে আমার জানা নেই। ফটো সাংবাদিক হিসেবে বহু, বহু অর্জন পাভেলের। ব্রাজিলের এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সমগ্র পৃথিবীর ফটো সাংবাদিকদের মধ্যে পাভেলের তোলা ছবি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। আমার বন্ধুদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাভেলই সবচেয়ে বড় জায়গা দখল করে আছে। আমরা কেউ তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারিনি। না আরেকজন পেরেছে, শাইখ সিরাজ। কৃষিতে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে সে। এ দেশের কৃষিক্ষেত্রে তার অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।
আবার পাভেলের কথায় ফিরি। গত ২০-২২ বছর ধরে 'এপি'তে কাজ করছে পাভেল। আমরা যারা পাভেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা জানি, মনের মতো একটা ছবি তোলার জন্য কী অমানুষিক কষ্ট পাভেল করে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সে। শেখ কামালের মতো আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পাভেলকে খুবই স্নেহ করেন।
পাভেল এখন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট আলভার্নিয়া হসপিটালে।
বছর চারেক আগে মিছিলের ছবি তোলার সময় পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে পাভেলের ঘাড়ের কাছে মেরেছিল। পাভেল রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। তার পরও সেই আঘাতের তোয়াক্কা না করে ক্যামেরা ক্লিক করে গেছে। ডাক্তাররা বলেছিলেন, এখন হয়তো তেমন কিছু হবে না, ভবিষ্যতে এই আঘাত বড় রকমের সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।
সেই সমস্যাই কি পাভেলকে আক্রান্ত করল?
কয়েক দিন আগে পাভেল আমাকে ফোন করে বলল, 'আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা। ডাক্তার ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়েছেন, সঙ্গে ঘুমের ওষুধ। আমি দুদিন ধরে ঘুমাচ্ছি। কিন্তু ব্যথা কমছে না।'
আমি চিন্তিত হলাম। কেন এ রকম মাথাব্যথা হচ্ছে পাভেলের?
আরেক দিন ফোন করে শুনলাম, সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। পাভেলের মাথার দুই জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ব্যথার কারণ জমাটবাঁধা রক্ত।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
দ্বিতীয়বার সিটিস্ক্যানেও একই রেজাল্ট। ঢাকার ডাক্তাররা বলেছেন, চিকিৎসা হচ্ছে ড্রিল দিয়ে মাথার ওই দুটো জায়গা ফুটো করে রক্তটা বের করে ফেলতে হবে।
পাভেলের বড় ভাই ডাক্তার। তিনি পাভেল আর পাভেলের স্ত্রী শাহিনাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেলেন। হাসপাতালে পাভেলকে আমি ফোন করলাম। পাভেল বলল, 'এখানকার ডাক্তারদের ওষুধে মাথাব্যথাটা একদমই চলে গেছে। আবার সিটিস্ক্যান করা হবে। ডাক্তাররা আশা করছেন ড্রিল করে জমাটবাঁধা রক্তটা হয়তো বের করতে হবে না। ওষুধেই সেরে যেতে পারে।'
শুনে আমার বুকের পাথর নেমে গেল। পরম করুণাময় যেন তা-ই করেন। ওষুধেই যেন পুরোপুরি সেরে ওঠে আমার বন্ধু।
পাভেলকে বহুবার মেরেছে পুলিশ। নব্বইয়ের আন্দোলনে নূর হোসেনের সেই বিখ্যাত ছবিটি তুলেছিল পাভেল। নূর হোসেন তাঁর বুকে লিখেছিলেন, 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু আমার সাংবাদিক ভাই-বন্ধুরা পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পাননি। তাঁরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন, পুলিশ যেভাবে ইচ্ছা মারছে তাঁদের।
সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে শুয়ে পাভেল আমাকে বলল, 'এপিতে ঢোকার পর ওরা আমাকে ওয়াশিংটনে পোস্টিং দিতে চেয়েছিল, সিঙ্গাপুরে পোস্টিং দিতে চেয়েছিল। যদি তখন চলে যেতাম তাহলে জীবনটা অন্য রকম হতো। পুলিশের হাতে এত মার খেতে হতো না। অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে আসতে হতো না।'
এরপরই বলল, 'না রে, ওই জীবনটা না নিয়ে ভালোই করেছি। পুলিশ মারুক আর যা-ই করুক, বাংলাদেশ আমার দেশ। আমি আমার দেশটাকে খুব ভালোবাসি। ওয়াশিংটনে চলে গেলে চাঁদের গাড়ির ছবি আমি কোথায় পেতাম? ঘূর্ণিঝড়ের ছবি কোথায় পেতাম? কোথায় পেতাম নূর হোসেনকে? আর এই যে কয়েক দিন আগে চায়নায় এত বড় একটা পুরস্কার পেলাম, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটো ট্রেনের একটি থেকে আরেকটিতে লাফ দিয়ে যাচ্ছে একজন মানুষ, এই ছবি আমি কোথায় পেতাম?'
পাভেলের কথা শুনে আমার চোখে পানি এলো।
পাভেলের বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। ঢাকার সিটি এসপি ছিলেন। কী অসাধারণ মানুষ! কী বিনয়ী, কী নম্র। হুমায়ূন আহমেদের বাবা পুলিশের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। একাত্তরে শহীদ হন। হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন লেখায় সেই মহান বাবার কথা পড়ে আমরা আপ্লুত হয়েছি। বাংলা ভাষার বিখ্যাত লেখক 'সূর্য দীঘল বাড়ি' খ্যাত আবু ইসহাক পুলিশের কর্তাব্যক্তি ছিলেন। আমার প্রথম উপন্যাস 'যাবজ্জীবন' আর তাঁর 'মুখর মাটি' পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল বাংলা একাডেমীর 'উত্তরাধিকার' পত্রিকায়। '৭৬ সালের কথা। বই করার সময় নামটা বদলে দিলেন আবু ইসহাক সাহেব। নাম দিলেন 'পদ্মার পলিদ্বীপ'। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। '৮৫-'৮৬ সালের এক দুপুরে 'পদ্মার পলিদ্বীপ' হাতে নিয়ে আবু ইসহাক সাহেব আমার গেণ্ডারিয়ার বাসায় এসে হাজির। আমাকে বইটি দিতে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যের এত বড় একজন লেখককে আমার দরজায় দেখে আমি যে কী অভিভূত হয়েছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না।
আবুল খায়ের মোসলেউদ্দীন পুলিশের বড় কর্তাদের একজন ছিলেন। প্রচুর লিখতেন। বাজারে তাঁর অনেক বই। '৮৩ সালের দিকে ভালো রকমের পুলিশি ঝামেলায় পড়েছিলাম। মোসলেউদ্দীন ভাই বুক দিয়ে আমাকে আগলে ছিলেন।
কত বড় হৃদয়ের ভালো ভালো মানুষ ছিলেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। এখনো যে নেই সে কথা আমি বলছি না। এখনো নিশ্চয়ই বহু ভালো মানুষ আছেন পুলিশে। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার উচ্চশিক্ষিত, নম্র, বিনয়ী, অতিসজ্জন একজন মানুষ। সাহিত্য পড়ার অভ্যাস আছে। এক অনুষ্ঠানে আমাকে বললেন, "আপনার 'নূরজাহান' ফার্স্ট পার্ট পড়ার পর বাকি দুটো পর্ব আর খুঁজে পাইনি।" আমাদের রিপোর্টার ওমর ফারুকের হাতে হাসান মাহমুদ সাহেবকে আমি 'নূরজাহান' পাঠিয়েছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদকে আমি খুবই পছন্দ করি। ইংরেজি সাহিত্য পড়া মানুষ। অত্যন্ত স্মার্ট, অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেন। কদিন আগে তাঁর অফিসে দুটো পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হলো বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে। ঘুমন্ত অবস্থায় বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো যে বাস ড্রাইভারকে, তাঁর পরিবার আর সেই সাহসী মানুষটির পরিবারকে, ছিনতাইকারীদের হাত থেকে তিনজন নারীকে রক্ষা করতে গিয়ে যিনি জীবন দিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানে এত সুন্দর বক্তৃতা করলেন বেনজীর আহমেদ, আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনলাম। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অনেক গুণী মানুষ জড়িত আছেন। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে দুজন মানুষের কথা। ইব্রাহিম ফাতমী এবং ডি এ তায়েব। দুজনকেই আমি খুব স্নেহ করি। ফাতমী চমৎকার আবৃত্তি করেন। তাঁর আবৃত্তির সিডি 'তোমার আঁচলে জ্যোৎস্না' প্রায়ই শুনি আমি। ডি এ তায়েব অভিনেতা। টিভি নাটকে ভালো অভিনয় করেন। তাঁর অভিনয় আমার ভালো লাগে। নিশ্চয়ই এসব মানুষের বাইরেও আরো অনেক গুণীজন আছেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আমাদের বীর পুলিশ বাহিনী, অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল দেশের জন্য, তাদের সেই আত্মত্যাগ বাঙালি জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
দুঃখের বিষয়, এত কিছুর পরও পুলিশ আমাদের বন্ধু হতে পারল না।
কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছিলাম, পুলিশ বিভাগে সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন ঘটছে। স্মার্ট টগবগে শিক্ষিত যুবকরা পুলিশে ঢুকছে। রাস্তাঘাটে সানগ্লাস পরা, মোটরসাইকেল নিয়ে টহল দেওয়া স্মার্ট পুলিশ সার্জেন্টদের দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রখর রোদে, জান বেরিয়ে যাওয়া গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরের দুর্বিষহ যানজট থেকে আমাদের মুক্ত করার জন্য এসব সার্জেন্ট এবং ট্রাফিক পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করেন। আমরা তাঁদের চেষ্টা দেখতে পাই, কষ্টটা টের পাই। তাঁদের জন্য আমাদের সহানুভূতিও জাগে। কিন্তু এসব সহানুভূতি মুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় পুলিশের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে। হঠাৎ করেই পুলিশের যেন সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন সাংবাদিকরা। যেখানে যেভাবে পারছে সাংবাদিকদের তারা মারছে। কিল-ঘুষি-চড়-লাথি আর লাঠিপেটা।
কয়েকটি ঘটনা বলি।
২৬ মে শনিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের ছাত্রীদের বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন দৈনিক প্রথম আলোর তিনজন ফটো সাংবাদিক। প্রকাশ্য রাজপথে ফটো সাংবাদিক সাজিদ হোসেনকে ঘিরে ধরে একদল পুলিশ কিল, ঘুষি, চড় আর লাঠিপেটা করে একসময় লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। এই দৃশ্য দেখে সাজিদের সহকর্মী জাহিদুল করিম এগিয়ে যান। পুলিশ একই কায়দায় তাঁর ওপরও আক্রমণ চালায়। দুই সহকর্মীর এ অবস্থার কথা শুনে ছুটে যান প্রথম আলোর আরেক ফটো সাংবাদিক খালেদ সরকার। পুলিশ তাঁর ক্যামেরা কেড়ে নেয়, তাঁকেও কিল-ঘুষি, চড়-লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশন পর্দায় এসব সাংবাদিকের অবস্থা দেখে দেশবাসী শিউরে উঠেছে। অথচ ৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিক নেতাদের বৈঠকে বলেছিলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই কি সেই পদক্ষেপ নেওয়ার ফল? পরে আবার তিনি বললেন, 'পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।'
এই কি ভালো হওয়া?
কালের কণ্ঠের পাবনা আঞ্চলিক প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে লিখেছিলেন। সেই লেখার কারণে ১০-১২ জন সন্ত্রাসী মামুনকে আক্রমণ করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ কথা শুনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে খুবই তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, 'আমার কিছু দুষ্টু আত্মীয় আছে, এটা তাদের কাজ।' দুদিন আগে সাংবাদিকদের তিনি পুলিশ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিলেন।
কী আশ্চর্য কথা!
ড. কামাল হোসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, 'সাংবাদিক নয়, পুলিশকে দূরে থাকতে বলুন।'
এরপর গত কয়েক দিনে পুলিশের নির্যাতন আরো বেড়ে গেল। আদালত চত্বরে তিন সাংবাদিককে পেটাল পুলিশ। কালের কণ্ঠের আবদুল জলিল, বাংলাদেশ প্রতিদিনের তুহিন হাওলাদার এবং প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কর্মকার। আদালতপাড়ার পুলিশ ক্লাবে একটি মেয়েকে শ্লীলতাহানি করল পুলিশ, মেয়েটির মা-বাবাকে লাঠিপেটা করল। মেয়েটি আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সেই ঘটনা জানানোর ফলে মেয়েটি তো অপদস্থ হলোই, তার মা-বাবা অপদস্থ হলেন, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পিটিয়েই ক্ষান্ত হলো না পুলিশ, মেয়েটি আর তার মা-বাবাকে নিয়ে গেল কোতোয়ালি থানায়। খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানায় ছুটে গেলেন আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। তিনি বহু চেষ্টা-তদবির করে মেয়েটি ও তার পরিবারকে উদ্ধার করলেন।
শ্রদ্ধেয় সুলতানা কামাল, আপনাকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। এখনো আপনার মতো কিছু মানুষ আছেন বলেই আমাদের দাঁড়ানোর জায়গাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি।
গত কয়েক দিনে দেশের বড় পত্রিকাগুলোয় সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের যেসব ছবি আর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনেই হচ্ছে না আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বসবাস করছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই দেশেই ঘটছে এসব ঘটনা! সাংবাদিকরা কী ক্ষতি করেছেন পুলিশের? তাদের অপকর্মের কথা লিখছেন বা ছবি তুলছেন, এই কি অপরাধ? নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো ইঙ্গিত, অন্য কোনো কারণ?
বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম লিখেছেন, 'সাংবাদিক নির্যাতনের পরিণতি ভালো হয় না।' সত্য কথা। কারণ যত নির্যাতনই করা হোক না কেন, সাংবাদিকরা থেমে থাকবেন না। তাঁদের কলম এবং ক্যামেরা পুলিশের রাইফেল আর লাঠির চেয়ে কোটিগুণ শক্তিশালী। সুতরাং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে লাভ হবে না। পুলিশ বাহিনীর মনোভাব অবশ্যই বদলাতে হবে।
এ অবস্থায় একটুখানি আশার আলো দেখতে পেয়েছি, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের কথায়। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে বিরোধে না জড়াতে পুলিশ বাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন দেখার পালা, তাঁর নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়। তা না হলে যে ভয়ংকর খেলায় পুলিশ নেমেছে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। দেশের প্রত্যেক সাংবাদিক হাতে হাত ধরে দাঁড়াবেন, তাঁদের কলম এবং ক্যামেরা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.