রমণীয় নয়-রাষ্ট্রের দায় কেন নারীর জরায়ুতে চাপিয়ে দেওয়া? by মালেকা বেগম

নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কয়েকটি নীতিগত ঘোষণার বিষয়ে চিন্তিত হতে বাধ্য হয়েছি। রাষ্ট্রের প্রধান অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো বক্তব্য দেন, ঘোষণা দেন, তখন আমরা গুরুত্ব দিয়ে সেই বিষয়ে বিশ্লেষণ করি, সুদূরপ্রসারী ফলাফলের বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ কী হতে পারে, সেসব নিয়েও আমরা না ভেবে পারি না।


আজ তেমনি ভাবছি, প্রধানমন্ত্রীর দুটি ঘোষণা এবং বক্তব্যের বিষয়ে—একটি হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে তাঁর নিশ্চিন্ত ও শঙ্কাহীন আশাবাদের কথা; অপরটি হচ্ছে, সন্তানসম্ভবা পেশাজীবী নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানোর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনের সমর্থনে তাঁর নারীবান্ধব ঘোষণা।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির দায় নারীর জরায়ুতে স্থান পেল
প্রধানমন্ত্রী এই দুটি বিষয়ে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দৃঢ়ভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ঘোষণা দিয়ে সমাজ-প্রশাসন-শ্রম-কর্মসংস্থানের সমস্যাকে ঘিরে নারীর ভূমিকার গুরুত্ব চিহ্নিত করেছেন। ঘোষিত বক্তব্যে তিনি নারীর মাতৃত্ব ও সন্তান জন্ম দেওয়ার, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথা নবজাত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে শঙ্কাহীন আশাবাদ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কতটা নারীবান্ধব এবং দেশের প্রগতি-উন্নয়নবান্ধব তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রশংসার কথা আমরা কয়েক বছর আগেও শুনতাম। জাতীয় আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমজীবী নারীদের অবদানের বিষয়ে গবেষক, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদেরা যেমন স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তেমনি দেশের জন্মশাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রশংসা পাওয়ার মূল কৃতিত্ব নারীসমাজের—সেই স্বীকৃতিও বাংলাদেশ সরকার, গবেষক, নীতিনির্ধারকেরা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জন্মশাসনের ব্যবস্থাদি নারীস্বাস্থ্যের হুমকিস্বরূপ বলে বিশ্বাস করেন নারীগবেষক, নারী আন্দোলনের নেত্রী-সংগঠকেরা। নারীর বিকাশে (পরিবারে ও রাষ্ট্রে) এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে, সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিকসহ সব রকম উন্নয়ন ও পরিবেশ উন্নয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধিক সন্তান-অধিক জনসংখ্যা অন্যতম বাধা হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবাই ঝুঁকির শিকার হচ্ছেন বলে জনসংখ্যা কমানোর সক্রিয় প্রচেষ্টাও চালিয়েছে পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক সব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ দেশের জনসংখ্যা কমছে না, বেড়েই চলেছে এবং এখন প্রথাসিদ্ধভাবে নারীর দিকেই অভিযোগ-নিন্দা-দায় চাপানো হচ্ছে। নারীই তো সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এবং জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন!
রাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করছে আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা তহবিল ও নারীর ক্ষমতায়নবিষয়ক জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো। নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর প্রতি এই দায় নাকচ করে এবং রাষ্ট্রের দায়ও কাঁধ থেকে ঝেড়ে দিয়ে হাসিমুখে রাষ্ট্রীয় এক ভাষণে বললেন, বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠিকে আমি শক্তি মনে করি, বোঝা নয়। তাই জনসংখ্য নিয়ন্ত্রণে কত দুর পর্যন্ত যাব তা আমাদের ভাবতে হবে। তিনি আরো বললেন, পৃথিবীর বহু দেশে তরুণ বয়সী কর্মক্ষম মানুষ কমে যাচ্ছে, কাজ করার লোকের অভাব রয়েছে। আমাদের বাড়তি কর্মক্ষম তরুণ জনগণকে শিক্ষিত করে পৃথিবীর সেসব দেশে পাঠাব। তাতে ব্যক্তি, পরিবার, দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করবে।
শ্রদ্ধেয় নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী (অজান্তে!) রাষ্ট্রের দায়টা নারীর ‘জরায়ু’তে ছাপিয়ে দিলেন কেন সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়ায় নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ায় এবং ছেলে সন্তান একজন হলেও জন্ম দিতে হবে প্রত্যেক স্ত্রীকে—এই দায় তো যুগ যুগ ধরে নারীর ভূমিকার মধ্যে, কাজের মধ্যে, কৃতিত্বের মধ্যে প্রধান গুণ বলে চালু রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ‘পারিবারিক আইন’ (মুসলিম), হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সমাজের প্রচলিত বিয়ে ও সন্তানের অভিভাবকত্ব আইনগুলো; পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন, সামাজিকীকরণ-প্রক্রিয়ায় পুরুষ আধিপত্য, পুরুষ ও পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, নীতিমালা, বিশ্বাস ও চেতনায় অব্যাহত প্রক্রিয়ার জোটবন্ধনের ফলে ‘সোনায় সোহাগা’ ঘটেছে। নারীর কাঁধে এবং জরায়ুতে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার (বিয়ের আগের ও পরের) এই দায় চাপিয়ে রেখেছেই।

অধিক সন্তান জন্মনিয়ন্ত্রণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অবনতি
সম্প্রতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এই বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভায় ২৭ জুন, রোববার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে রাষ্ট্রের এক নম্বর সমস্যা বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে (পত্রিকার খবর)। প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদীয় কমিটির পরস্পরবিরোধী ঘোষণার ফলে আমরা বুঝতে পারছি, নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী আবেগের বশে তাঁর দিবাস্বপ্নকে (অবাস্তব) প্রচার করেছেন। অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক সংসদীয় কমিটি সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য না দিলেও মূলগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে নাকচ করে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করে বলেছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক হার দেশ-নারী-সমাজের জন্য প্রধান সমস্যা। এই বক্তব্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্র ও সরকার বহু বছর ধরেই (১৯৭২ সাল থেকে) দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষনশীল-পিতৃতান্ত্রিক-সনাতনী নীতিমালা, আইন, মানসিকতা বজায় রাখা হচ্ছে।
একাধিক সন্তান হওয়া বন্ধের জন্য পুরুষের তথা স্বামীর জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থাদির বহুল প্রচার এবং প্রচলনের বিষয়ে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মেনে নিলেও দেখা যাচ্ছে স্ত্রী নিজেই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সামাজিক উত্ত্যক্ততার অনেক ব্যাধি বহু পরিবারেও বাসা বেঁধেছে। স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে লাঞ্ছনা, স্ত্রীকে সন্দেহ করা ইত্যাদি অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পরিবার পরিকল্পনার ব্যবস্থাদির জন্য স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী আলোচনা করতে বিরত থাকেন। সন্দেহপ্রবণ স্বামীকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাতেও স্ত্রী ভয় পান। নিজেই ব্যবস্থা নিয়ে নিজের স্বাস্থ্যহানি করতে স্ত্রী বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি ‘কনডম’-এর অকার্যকারিতার বা ‘ভেসেকটেমি’র অকার্যকারিতার ফলে স্ত্রী যদি সন্তানসম্ভবা হন, তখন সন্দেহপ্রবণ স্বামী নানাভাবে নির্যাতন করে স্ত্রীকে এতটাই উত্ত্যক্ত করেন যে স্ত্রী রেহাই পেতে পরিবার পরিকল্পনার কোনো ব্যবস্থা নিতেই আগ্রহী হন না।
পরিবারগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অবনতি ঘটছে, সন্তান জন্মরোধে ব্যবস্থাদি কে নেবেন? স্বামী-স্ত্রী উভয়েই স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহী। অস্থায়ী ব্যবস্থাদি নিতেও অনাগ্রহী। কিন্তু যেকোনো শ্রেণীর, জাতিসত্তার, সংস্কৃতির, ধর্মের পরিবারগুলোতে ক্ষমতাসম্পর্কের আধিপত্য পুরুষের ভূমিকার মধ্যেই প্রকট। স্ত্রী সব ক্ষেত্রেই অশান্তি এড়াতে মেনে নেন, আর না মানলে অশান্তিময় হয়ে ওঠে নারীর জীবন।
এই তো বাস্তব পরিস্থিতি। শিক্ষা, পেশাগত জীবন, বুদ্ধিমত্তা এ ক্ষেত্রে নারীকে নিজের পথ বেছে নেওয়ার শক্তি জোগায়। এসব গুণের অভাবে বছর বছর সন্তান জন্মদানে স্ত্রী কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যায়। স্বামীর জন্য বহুবিবাহ আইনি অস্ত্র তো রাষ্ট্রই জুগিয়েছে এবং অব্যাহতভাবে তা প্রযোজ্য হতেও সহায়তা দিচ্ছে।

সন্তানবতী পেশাজীবী নারীর ছয় মাস ছুটির প্রসঙ্গ
বিশ্ব নারী আন্দোলনে, আইএলও, জাতিসংঘের শ্রম আইনে এই নির্দেশ আছে যে, পেশাজীবী নারী সন্তান জন্মদানের মাহাত্ম্যের জন্য স্বাস্থ্যগত কারণে ও সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার প্রয়োজনে শিশু জন্মের আগে-পরে সমভাবে কমপক্ষে তিন মাস বা চার মাস বা ছয় মাস সবেতন ছুটি দিতে হবে। বর্তমানে ছয় মাস ছুটি দেওয়ার আইন জাতিসংঘ ঘোষিত।
নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পেশাজীবী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ছয় মাস ছুটি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ঘোষণা দিয়েছেন। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। তবে কায়িক শ্রমিক নারী ইটভাঙা কাজে, বাড়ি তৈরির কাজে, কৃষি কাজে এমনকি গার্মেন্টস শ্রমিক নারীদের কাজের (যাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই) স্বীকৃতি রাষ্ট্র, সরকার, সাংসদেরা দিচ্ছেন, কিন্তু নিয়োগপত্র, বেতন-বিধিমালা বিষয়ে নিশ্চুপ থাকছেন। ফলে প্রায় ৮০ শতাংশ দরিদ্র শ্রমজীবীরা কিন্তু এই ছুটি পান না, কোনো দিন পাবেও না। ‘দিন আনে দিন খায়’ শ্রমজীবী নারী ছুটি চান না, কাজ চান। ৮০ শতাংশ নারীর প্রতিদিনের কাজের নিশ্চয়তা এবং কাজের সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে এই ব্যবস্থাও করতে হবে যেন মা তাঁর কোলের শিশুকে নিয়ে নিরাপদে কাজ করতে পারেন। সেই সঙ্গে আমরা চাইছি, কর্মজীবী-শ্রমজীবী বাবাও যেন তাঁর শিশুকে নিয়ে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলেন ও সেই ব্যবস্থাও কর্তৃপক্ষ করে দেবে।
মাতৃত্বকালীন ছয় মাসের ছুটি পেশাজীবী মায়েরা যেন শিশুর জন্মের আগে এবং পরে ছুটি নেওয়ার আইন ভঙ্গ না করেন, সেটাও কর্তৃপক্ষকে মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ৪০ বছরের দাবি এই ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’ (ক্রমশ এক মাস, তিন মাস, চার মাস, ছয় মাস) সম্প্রতি ছয় মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি পাওয়ায় পেশাজীবী নারীরা আনন্দিত। নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের দাবিতে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ রয়েছে যে, মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় অফিসের যেসব প্রশিক্ষণ হয় এবং প্রমোশনের যে বিধিমালা কার্যকর হয় তা যেন মাতৃত্বকালীন ছুটিপ্রাপ্ত নারীর প্রমোশন, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করে। ইউরোপ, আমেরিকা এবং ভারত-শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার বহু দেশে মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকারের সঙ্গে অন্য সহকর্মীদের সমঅধিকার বহাল রাখার আইনি ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারীবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় ও আইনি পদক্ষেপে একই সঙ্গে ছুটির অধিকার ও পদোন্নতির অধিকার যুক্ত না থাকলে শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়বেন পেশাজীবী শ্রমজীবী নারীরা। আমরা আশা করছি, অধিক সন্তান জন্মদান নিরুৎসাহিত করতে পারিবারিক আইনে নারীর অধিকারবঞ্চনা সংশোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী এবং মাতৃত্বকালীন ছুটিকে দয়া নয়, অধিকার হিসেবে ঘোষণা দেবেন, আইন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
মালেকা বেগম: উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.