সমকালীন প্রসঙ্গ-র‌্যাব ও পুলিশের অপ্রতিহত 'ক্রসফায়ার' by বদরুদ্দীন উমর

একটি নিরীহ ছেলেকে গুলি করে আহত ও চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিলেও এ নিয়ে তাদের কোনো 'ভুল' স্বীকার নেই। উল্টো তাদের প্রমাণবিহীন বক্তব্য হলো, লিমন একজন সন্ত্রাসী এবং তার আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই তারা তাকে গুলি করেছিল।


একটি নিরস্ত্র ছেলে কীভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল, এর মাথামুণ্ডু বোঝা কোনো স্বাভাবিক লোকের পক্ষে সম্ভব নয়


ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামে বিগত ১৩ মার্চ লিমন নামে ১৬ বছরের একটি গরিব ছেলে র‌্যাবের গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে তার একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। ছেলেটি কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র হলেও তাকে সংসারের কাজকর্ম করতে হতো। ঘটনার সময় মাঠ থেকে নিজেদের গরু ফিরিয়ে আনার জন্য সে ঘর থেকে বের হয়েছিল। বাংলাদেশে এখন র‌্যাব ও পুলিশ যে পাখি মারার মতো করে মানুষ মারছে, এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই। খুব নিয়মিতভাবে ও ঘন ঘন তারা নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষ খুন করে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিত হয়েছে। দেশজুড়ে তাদের সন্ত্রাসী খুনখারাবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে থাকলেও এভাবে র‌্যাব ও পুলিশের বেপরোয়া খুনখারাবি বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদের এই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণ কারও কাছে এদের জবাবদিহিতা বলে কিছু নেই এবং জবাবদিহিতা না থাকার কারণ আবার হলো এই যে, যাদের কাছে এই জবাবদিহিতার কথা, তারাই এদের এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সমর্থক ও উৎসাহদাতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সরকারের শীর্ষতম থেকে নিয়ে নিম্নতম পর্যায়ের লোকজন যেভাবে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে র‌্যাব ও পুলিশের হত্যাকাণ্ডের সমর্থক, তাতে র‌্যাব ও পুলিশ এই শাসকশ্রেণী এবং এদের যে কোনো সরকারের আমলে নিজেদের এই সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করবে, এমন চিন্তা বা ভরসার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আজকের বাংলাদেশে শাসকশ্রেণীর সর্বস্তরে ফ্যাসিবাদের বাতাস বইছে এবং সরকারই পরিণত হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিপজ্জনক ফ্যাসিবাদী শক্তিতে।
র‌্যাবের গায়ের জোর অনেক। কাজেই একটি নিরীহ ছেলেকে গুলি করে আহত ও চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিলেও এ নিয়ে তাদের কোনো 'ভুল' স্বীকার নেই। উল্টো তাদের প্রমাণবিহীন বক্তব্য হলো, লিমন একজন সন্ত্রাসী এবং তার আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই তারা তাকে গুলি করেছিল। গরু আনতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়া একটি নিরস্ত্র ছেলে কীভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল, এর মাথামুণ্ডু বোঝা কোনো স্বাভাবিক লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব কথা বলে র‌্যাব ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে ঝুলিয়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তার একটি পা কেটে ফেলার পর সে সেখানে চিকিৎসাধীন ছিল এবং পরে আদালত তাকে ছেড়ে না দিয়ে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে আটক রেখেছে। এর মধ্যে যে এ দেশের বিচারব্যবস্থার বেহাল অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়, এতে সন্দেহ নেই। এই বেহাল অবস্থার আরও একটা প্রমাণ পাওয়া যায়, হাইকোর্ট কর্তৃক লিমনকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশের তিন দিন পরও জামিনের হুকমনামা বরিশাল কেন্দ্রীয় হাসপাতালে না পেঁৗছানোর মধ্যে।
আদালতকে সরকার কর্তৃক বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো পরিস্থিতি যদি এ দেশে সৃষ্টি না হতো, তাহলে দেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতো। কিন্তু আদালতের অবস্থা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো হয়ে পড়ায় এদিক দিয়ে পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, তা রীতিমতো বিপজ্জনক। র‌্যাব ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে একটি নিরীহ গরিব ছেলেকে পঙ্গু করে দেওয়া এক অমানবিক ব্যাপার। এ অমানবিক ব্যাপারের বিরুদ্ধে আদালতের যেভাবে কাজ করা দরকার, তার বিপরীত কাজ করে র‌্যাবের প্ররোচনায় তাকে আটক করা হয়েছে। পরে হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে আবেদনের পর কোর্ট তাকে জামিন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নির্দেশ দিলেও সে নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে কি না অথবা প্রয়োজনীয় দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে কি না সেটা দেখার কোনো ব্যাপার হাইকোর্টের নেই! নির্দেশ জারি হওয়ার তিন-চার দিন পরও তা বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে এখনও না পেঁৗছানোর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আসলে এ নির্দেশ যেখানে জরুরিভাবে ঢাকা থেকে সেদিনই পেঁৗছানো সম্ভব, সেখানে এই বিলম্বের কারণ নিদারুণ গাফিলতি ছাড়া আর কী? কেন এই গাফিলতি হলো, তার হিসাব হাইকোর্টেরই নেওয়া দরকার। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে হাইকোর্টের কোনো ভূমিকা নেই। বস্তুতপক্ষে কোনো ক্ষেত্রেই তাদের এ ভূমিকা দেখা যায় না। এর একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো, ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদীগুলোকে বেআইনি দখলমুক্ত করার জন্য হাইকোর্টের একের পর এক নির্দেশ। এ নির্দেশ কখনও ঠিকমতো পালিত হয় না অথবা একেবারেই পালিত হয় না। একটি দেশে আদালতের এ অবস্থা থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার আর কী হতে পারে?
প্রথমত দেখা যায়, যারা দুর্বল, যারা বেকায়দা অবস্থায় থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের কেস থানায় গ্রহণ করে না। অনেক সময় পুলিশ ঘুষ খেয়ে এ কাজ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণেই এটা ঘটে থাকে। সরকারি কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎ হস্তক্ষেপে অথবা সরকারের বিরাগভাজন না হওয়ার চেষ্টা থেকে, এমনকি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েও থানার দারোগা অনেকের কেস নেয় না। এভাবে কেস না নেওয়াও এক গুরুতর অপরাধ এবং এর মাধ্যমে বাস্তবত মানবাধিকার লঙ্ঘনই হয়ে থাকে। কিন্তু এদিকে খেয়াল করার মতো কোনো শক্তি দেশের বর্তমান শাসন কাঠামোর মধ্যে নেই। লিমনকে গুলি করে আহত করার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলেও এ ব্যাপারই ঘটে। পুলিশ কেস নিতে অস্বীকার করে। পরে এ ধরনের প্রকাশ্য অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃক মামলা গ্রহণে অস্বীকৃতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হলে শেষ পর্যন্ত থানা কেসটি নিতে বাধ্য হয়।
র‌্যাব ও পুলিশের খুনখারাবি ও আইনবহির্ভূত এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় সম্পর্ক আছে, এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এই মর্মে ৯ মের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে কার্টুনসহ একটি বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ওই একই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় আকারে প্রথম খবর হিসেবে ছাপা একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে অফিসারকে লিমনের কেস তদন্তের জন্য ঝালকাঠিতে পাঠিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে শুধু প্রকৃতপক্ষে তদন্তের কোনো কাজই করেননি। লিমনের পরিবার ও গ্রামের লোকজন অভিযোগ করেছেন (ডেইলি স্টার ৯.৫.২০১১) যে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও রাজাপুর থানার অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে তদন্তকারী অফিসার বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ঘটনাস্থলে গিয়ে লিমনের পরিবার বা গ্রামের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী লোকের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলে শুধু র‌্যাবের লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই ফেরত গেছেন! র‌্যাব ও পুলিশ যে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হয়েই কাজ করছে, এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নামে কথিত পুলিশ ও র‌্যাব নিজেই যেভাবে সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের মতো কাজ অবাধে করে চলেছে, তাতে বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে যে নিরাপত্তার অভাব বোধ থাকবে, এটা স্বাভাবিক। একদিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এ ধরনের বাহিনীর মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ এবং অন্যদিকে সে কার্যকলাপের কোনো প্রতিকার বা বিচারের সুব্যবস্থা করতে আদালতের অপারগতা দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতির ভয়াবহতার অন্য একটি দিক হলো, এর বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ হলেও যেভাবে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে ওঠা দরকার, তার কোনো দেখা এখানে পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ এখানে হয় মোটামুটি একটা রুটিন ব্যাপার হিসেবে এবং এই নির্যাতনকে শিরোধার্য করেই অধিকাংশ লোক বসে থাকে। সরকার এভাবে নিজস্ব বাহিনীর মাধ্যমে যে সন্ত্রাস করে এবং এর ছত্রছায়ায় সরকারবহির্ভূত নানা উচ্ছৃঙ্খল ও অপরাধী শক্তি যেভাবে অবাধে সন্ত্রাস করে চলে তার ভিত্তি হলো, জনগণের মধ্যে এর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধের অভাব। এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির অভাব।
৯.৫.২০১১

No comments

Powered by Blogger.