প্রযুক্তি ও নৈতিকতা-ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম

কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে একটি প্রহসনমূলক নাটিকা দেখানো হয়েছিল। বিষয়বস্তু ছিল নদীভাঙনের ওপর। নদীপারের ঘরবাড়ি ভেসে গিয়েছিল। গরু-মোষ নিয়ে চাষিরা পরিবারসহ চরম বিপাকে পড়েছিল।


কিন্তু ঢাকা থেকে পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের একাধিক সাংবাদিক দল গিয়ে তাদের দুরবস্থার দিকে না তাকিয়ে সেটিকে পুঁজি করে ভিডিওচিত্র ধারণ করে যাচ্ছিল। এক তরুণী সাংবাদিক একের পর এক চাষিদের স্পট ইন্টারভিউ করছিল, যা সরাসরি টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির অনুপম উন্নতির ফলে মানুষের দুরবস্থাকে সহজে সংবাদের বিষয় করে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু তাদের দুরবস্থা লাঘবের কোনো চেতনা ওই উৎসাহী যুব-সাংবাদিক দলগুলোর মধ্যে ছিল না। নাটিকার খোঁচাটি দারুণ লাগলেও ভুলে গিয়েছিলাম।
১৮ নভেম্বর ইয়াহুর ওয়েবসাইটের প্রধান খবরটি আমাকে আবার নাটিকাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। খবরটি হলো, বিল নায় নামের ৫৪ বছর বয়সী একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ক টিভি উপস্থাপক ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে যাওয়ার সময় মঞ্চের ওপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। খবরটি জোর দিচ্ছে, বিল নায় যাঁকে সায়েন্স গাই হিসেবে ডাকা হয় তাঁর জ্ঞান হারানোর ওপর নয়, বরং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের আচরণের ওপর। ছাত্রছাত্রীরা কেউ আসন ছেড়ে উঠলেন না। বরং, তাঁরা তাঁদের মুঠোফোন, আইপড ও ডিজিটাল ক্যামেরার সাহায্যে বিল নায়ের মঞ্চের ওপর পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে পাঠাতে লাগলেন। অ্যালিস্টার ফেয়ারব্যাংকস নামের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি দেখলাম, ছাত্রছাত্রীরা খবরটি নিশ্চিন্ত মনে এসএমএস এবং টুইটারে করে বাইরে পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হলো। একটি অসুস্থ লোককে সাহায্য করতে ছুটে না গিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা তাঁর অসুস্থতাকে খবরের বিষয় করে নিয়েছে। অর্থাৎ, বন্ধুজনকে খবর দেওয়ার উৎসাহ মানবতার মৌলিক আকাঙ্ক্ষার সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে, সেটি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেনি।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে ডিজিটাল সংস্কৃতির অমানবিক প্রবণতা বলে অভিহিত করেছে। প্রতিবেদনটিতে এ জাতীয় আরও অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এটা খুব খারাপ প্রবণতা তৈরি করছে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল-প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো ওই পর্যায়ে আসেনি, তবে প্রথম আলোর নাটিকাটির প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, আসতে কতক্ষণ।
বিল নায়ের অনুষ্ঠানে যাঁরা দর্শক ছিলেন, তাঁরা ছাত্রছাত্রী, পেশাগতভাবে সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের সবার কাছে তথ্য এবং সচিত্র তথ্য আদান-প্রদানের যন্ত্র সঙ্গে ছিল। সেভাবে বাংলাদেশে এখন লাখ লাখ লোকের হাতে অনলাইন মোবাইল, আইপড, ডিজিটাল ও ভিডিও-ক্যামেরা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আছে, ফলে যেকোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা অবলোকনের সময় তাঁরা তাৎক্ষণিক সাংবাদিক বনে যেতে পারেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও তাঁরা অন্তত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের কাছে দূরদূরান্তে সচিত্র খবর পাঠাতে পারেন। ডিজিটাল-প্রযুক্তির ব্যাপক জনব্যবহারের কারণে সেখানে কোন ঘটনাটি প্রচার করা উচিত বা উচিত নয়, সে ব্যাপারে কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না। আইন প্রয়োগ করেও জনগণের ডিজিটাল-প্রযুক্তির অমানবিক ব্যবহারকে ঠেকানো যাবে না। যেমন, নাটোরে যখন চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরকে রাস্তার ওপরে প্রতিপক্ষ দলের লোকেরা পিটিয়ে হত্যা করছিল, তখন যাঁরা ভিডিওচিত্র করছিলেন ঘটনার, তাঁরা কি নূরকে উদ্ধারের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন? বা যাওয়াটা কি সম্ভব ছিল? জনসাধারণ্যে ডিজিটাল-প্রযুক্তি ব্যবহারের বিধিনিষেধ আনার একমাত্র উপায় হলো তাঁদের মানবিক মূল্যবোধের কাছে আবেদন জানানো।
পেশাগত সাংবাদিকতায় অবশ্যই সচিত্র প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিধিবিধান মানতে হয়। শহীদ সাংবাদিক বিবিসির ঢাকার প্রতিনিধি নিজামুদ্দিনের মেয়ে শারমীন রিমাকে যখন তাঁর স্বামী মুনির হত্যা করেন, সে সময় বাংলাদেশে এখনকার প্রথম আলোর মতো সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল ইত্তেফাক। রিমার হত্যা প্রসঙ্গে অন্য পত্রিকাগুলো রগরগে খবর পরিবেশন করে চললেও ইত্তেফাক তার জনপ্রিয়তার তুলনায় এ ব্যাপারে ছিল অপেক্ষাকৃত সংযমী। কিন্তু এর অসহিষ্ণু পাঠককে নিরস্ত করতে ইত্তেফাক-এর তৎকালীন সম্পাদক মইনুল হোসেন একটি উপসম্পাদকীয়তে হলুদ সাংবাদিকতা আর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্যে তফাত ব্যাখ্যা করে একটি রচনা লিখেছিলেন।
ওই সময় ছিল প্রথাগত সচিত্র প্রতিবেদনের যুগ। তাৎক্ষণিকভাবে ছবি প্রেরণ করা ও ছাপানো যেত না। এখন যুগ হচ্ছে ডিজিটালের, তাই রিমার ছুরিকাহত ক্ষতবিক্ষত ছবি যে তাৎক্ষণিকভাবে পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো এবং টিভিতে দেখানো হতো, তার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কারণ, রক্তের লোলুপতা প্রদর্শনের লোভ সামলানো কঠিন। ডিজিটাল-প্রযুক্তি তাৎক্ষণিক উপস্থাপনাকে বাস্তবে সম্ভব করে সচিত্র সাংবাদিকতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যেমন, এবারের ওয়ার্ল্ড কাপে (দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০) উপস্থিত ছিলেন এমন একজন ক্রীড়া-সাংবাদিককে (সম্ভবত প্রথম আলোর পবিত্র কুন্ডু) পরে টিভিতে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুনলাম। কী যে আনন্দ, একদিকে খেলা দেখছেন আর অন্যদিকে কী দেখছেন, সেটা সঙ্গে সঙ্গে দেশে লাইভ পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
আগের যুগে সচিত্র প্রতিবেদনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নৈতিকতা তথা মানবতার সীমারেখাটা মানা হয়তো সম্ভব ছিল। যেমন, একটি বিখ্যাত ছবির কথা মনে পড়ছে, রোমান হলিডে পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি। বিষয় ছিল, রোম নগরে কাজ করছেন এমন একজন আমেরিকান সাংবাদিক (গ্রেগরি পেক), ঘটনাচক্রে তাঁর বাসায় অতিথি করে নিয়ে আসেন এমন একজনকে, যিনি পূর্ব ইউরোপের একটি দেশের রাজকন্যা (অড্রে হেপবার্ন)। কড়া রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতার কারণে তিনি ঐতিহাসিক রোম নগরকে নিজের মতো করে উপভোগ করতে পারছিলেন না। তাঁর অস্থিরতা দেখে চিকিৎসক তাঁকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিলেন। তার পরও ওই রাতে রাজকন্যা হোটেল থেকে গোপনে বের হয়ে গেলে ঘুমের বড়ির প্রভাবে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েন। রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে সাংবাদিক তাঁকে দেখে নিজের বাসায় এনে আশ্রয় দেন। এদিকে রাজপরিবারের তরফ থেকে রাজকন্যার নিরুদ্দেশের খবর গোপন রাখা হয়। শুধু তাঁর দৈনন্দিনের খবর ছাপা হয় ছবিসহকারে। ছবি দেখে সাংবাদিক বুঝতে পারেন যে তাঁর বাসায় আশ্রিতা আর কেউ নন, বরং সেই হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যা। তখন সাংবাদিকের মনে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যদি রাজকন্যার নিরুদ্দেশের খবর তাঁর পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়, তাহলে তাঁর পেশাগত এবং আর্থিক অনেক লাভ হয়। কিন্তু তাতে রাজপরিবারসহ রাজকন্যার মর্যাদা হুমকির মুখে পড়বে। সাংবাদিক ও রাজকন্যা কিছুটা নিজেদের অজান্তে একে অপরকে পছন্দ করে ফেলেন। সাংবাদিক শেষে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সংবাদটা প্রকাশ করবেন না। রাজকন্যাও হোটেলে ফেরত চলে আসেন। শেষ দৃশ্যে সংবাদ সম্মেলনে একদল সাংবাদিকের মধ্যে কাহিনির নায়ক সাংবাদিকও উপস্থিত। সবার অলক্ষ্যে রাজকন্যার সঙ্গে সাংবাদিকের দৃষ্টিবিনিময় হয়। চোখের পাতা নাচিয়ে সাংবাদিক রাজকন্যাকে ইশারায় জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের সম্পর্ক চলবে কি না। রাজকন্যা ততোধিক কুশলতায় চোখের পাতা নাচিয়ে নীরবে জানালেন, না। প্রেমবিষয়ক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটা সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ‘না’। কিন্তু আমার কথা হলো, আজকে ডিজিটাল-প্রযুক্তির যুগে গ্রেগরি পেকের পক্ষে কি সম্ভব হতো সাংবাদিক হিসেবে হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যার ছবি পত্রিকায় বা টিভিতে না পাঠিয়ে দেওয়া?
রোমান হলিডের অপূর্ব প্রেমালেখ্যের বিপরীতে আমি সেসব নজির আনতে চাইছি না, যা বাংলাদেশে এখন ইভ টিজিংয়ের নামে অহরহ ঘটে যাচ্ছে। যেমন, প্রেমিকার নগ্ন ছবি কিংবা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য পর্নো সিডিতে রূপান্তরিত করে বাজারজাত করা কিংবা প্রেমিকা বা প্রেমিকার পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করা। ডিজিটাল-প্রযুক্তি তাৎক্ষণিক বাণী রক্ষা ও দৃশ্যায়নের ব্যবস্থা হাতে হাতে পৌঁঁছে দেওয়ার কারণে শুধু অমানবিকতা নয়, নিষ্ঠুরতাও বেড়ে গেছে। ধরুন, আগে একটা পর্নো ছবি বানাতে পরিপূর্ণ সিনেমা বানানোর মতো আয়োজনের দরকার ছিল। এখন সেটা একান্তভাবে একটা বাসগৃহেও সম্ভব।
পেশাগত সাংবাদিকতায় হয়তো নিয়ন্ত্রণবিধি আরোপ করা সম্ভব। যেমন, বিডিআরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের গলিত দেহ প্রথম দিকে টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো হলেও পরের দিকে আর দেখানো হয়নি। কিন্তু প্রচারমাধ্যমের বাইরে ডিজিটাল-প্রযুক্তি-অনুপ্রাণিত অনৈতিকতা, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতা ঠেকানোর উপায় কী হবে? যেটাকে ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও খারাপ প্রবণতা বলে অভিহিত করেছে।
প্রযুক্তি সম্পর্কে শেষ কথাটা হলো, যেটা আমরা সবাই জানি, যে ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটা যায়, সে ছুরি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়। রেডিও, টেলিফোন, টিভি, কম্পিউটার, ক্যামেরা, মোবাইল, স্যাটেলাইট যত না খারাপ করেছে, তার চেয়ে আমি বলব, লাখ গুণ ভালো করছে মানুষের। সমস্যাটা রয়ে যাচ্ছে ব্যবহারের মধ্যে। যেমন, বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া পুরোটাই নির্ভর করছে ডিজিটাল-প্রযুক্তির ওপর। কিন্তু যে হারে যৌন-সংস্কৃতির আন্তর্জাতিকায়ন হয়, সে হারে হয় না সাহিত্য, অর্থনীতি ও বিজ্ঞানের।
আমাদের সমাজে বিকল্প সংস্কৃতি শক্তিশালী হলে ডিজিটাল-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার হবে। যেমন, একটি ডিজিটাল ক্যামেরায় যদি একটি যৌনদৃশ্য ধারণ করা হয়, তাহলে ১০টি ডিজিটাল ক্যামেরা থাকবে, যাতে সমাজের দুস্থ মানুষের কথা শুধু তথ্য হিসেবে নয়, তাদের সে দুস্থতা নিরসনে কী করা যায়, সে ভাবনাও তুলে ধরা যায়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.