সংসদ ও সুপ্রিম কোর্ট-দ্বৈরথ বনাম সাংবিধানিকতার বিকাশ by শেখ হাফিজুর রহমান

নির্বাহী বিভাগ যদি আইন মেনে না চলে বা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তা দেখার দায়িত্বও সুপ্রিম কোর্টের। সে জন্য লিখিত সংবিধানের দেশে সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। তবে আমরা চাইব যে, বিচারপতি, সাংসদসহ সকলেই সহনশীল হবেন এবং সংযত আচরণ করবেন। তাদের কথাবার্তা হবে দায়িত্বশীল ও আইনসম্মত।


নইলে গণতন্ত্রও হোঁচট খাবে, সাংবিধানিকতাও শক্ত ভিত্তি পাবে না

কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। উচ্চতর আদালত ও সংসদের দ্বৈরথে জাতীয় পর্যায়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের কাছে সড়ক ভবন হস্তান্তর করা নিয়ে গত ২৯ মে জাতীয় সংসদে একটি বিতর্ক হয়। সুপ্রিম কোর্টের জমি নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশের বিষয় উত্থাপিত হলে স্পিকার আবদুল হামিদ ২৯ মে সংসদে বলেন, 'সংসদে সংসদ সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন, সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয় তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে।' বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বৈত বেঞ্চ স্পিকারের এ মন্তব্যকে 'রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল' বলে মন্তব্য করেন। স্পিকারের প্রতি এ ধরনের মন্তব্যে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাংসদ রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে তিন দিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণের দাবি জানান। ১৮ জুন স্পিকার আবদুল হামিদ এ ব্যাপারে তার রুলিং প্রদান করেন। স্পিকার তার রুলিংয়ে বলেন, ৫ জুন হাইকোর্টের একজন বিচারক সংসদ ও স্পিকার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। স্পিকার সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য সাংসদদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান। স্পিকার আলোচ্য বিচারকের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করার বিষয়টি প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দেন। হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ব্যাপারে তিনি যে রুলিং দিয়েছেন সেখানেও দায়িত্বশীলতা, প্রজ্ঞা ও পরিপকস্ফতার স্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা'র অভিযোগ আনার পরও বিষয়টিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেননি। স্পিকারের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।
সুপ্রিম কোর্টের কাছে সড়ক ভবন হস্তান্তর করা নিয়ে ২৯ মে জাতীয় সংসদে একটি বিতর্ক হয়। ওই বিতর্কের সূত্র ধরে স্পিকার বলেন, 'দেশের মানুষের বিচার পেতে বছরের পর বছর লেগে যাবে, আর নিজেদের বিষয় হলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।' স্পিকারের এ মন্তব্যের প্রথম অংশটি বিচার বিভাগের শত বছরের পুরনো একটি সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করছে। স্পিকার দেশের মানুষের বিচার পেতে যে বছরের পর বছর লেগে যায় সে কথাটি বলেছেন। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় যে ক'টি প্রকট সমস্যা রয়েছে, তার একটি হচ্ছে বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়া। এক থেকে তিন বছরের মধ্যে একটি দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা থাকলেও একটি মামলা নিষ্পত্তিতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লেগে যায়। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা যখন রায় পান, তখন ওই রায় আর তাদের কোনো কাজে আসে না। বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রহসনে পরিণত হয়।
স্পিকারের মন্তব্যের প্রথম অংশটি বিচার বিভাগের একটি প্রকট সমস্যার উন্মোচন হলেও তার বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশের ব্যাপারে স্পিকারের আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেছেন, 'আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।' বিচার বিভাগের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। দেশে একটি বৈধ এবং কাঠামোবদ্ধ বিচার বিভাগ বা আদালত ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আদালতে গিয়ে মামলা করেন। মামলার রায়ে পরাজিত পক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এভাবে প্রথমে যে আদালতে মামলা হয়েছে সেখান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত আদালতের রায় পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। এভাবেই বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে আদালতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়।
স্পিকারের মন্তব্যকে 'রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল' বলে মন্তব্য করায় জ্যেষ্ঠ কয়েকজন সাংসদ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন যে, সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ সংসদকে আদালত থেকে দায়মুক্ত করেছে। তার মানে কি এই যে, সাংসদরা যা ইচ্ছা তাই বলবেন? তার মানে কি এই যে, সংসদ থেকে বলা হবে, 'আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে?' এসব কোনো দায়িত্বশীল কথা নয়। তবে এ ব্যাপারে স্পিকারের মন্তব্যকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর 'রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল' বলাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়েছে। তিনি বলতে পারতেন, আদালতের ব্যাপারে স্পিকারের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য বাঞ্ছনীয় নয়। প্রাসঙ্গিকভাবেই উলেল্গখ করতে চাই যে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা, সাংবিধানিকতা প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় যে সাহস ও প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য। তবে কিছু বিষয়ে তিনি সংযমের পরিচয় দিতে পারেননি। বিশেষ করে কয়েকজন সম্মানিত নাগরিককে আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখায় আমরা মর্মাহত হয়েছি।
জাতীয় সংসদের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংসদ সংসদকে সার্বভৌম বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু যে দেশে লিখিত সংবিধান রয়েছে, সে দেশের সংসদ কখনও সার্বভৌম হয় না। সংবিধান এখানে সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে বর্ণিত সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে কাজ করতে হয়। সংবিধান সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের এখতিয়ার সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সংবিধানের ৭, ২৬ ও ১০২ অনুচ্ছেদ অধ্যয়ন করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে সংসদ সার্বভৌম নয়। সংবিধান নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকেই সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হয়, সাংসদদের কথা বলতে হয়। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, 'প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।' আর লিখিত সংবিধানে সংবিধানের কর্তৃত্ব ও সর্বোচ্চতা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর। সংসদ যদি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করে, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার রয়েছে তা বাতিল করার। নির্বাহী বিভাগ যদি আইন মেনে না চলে বা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে, তা দেখার দায়িত্বও সুপ্রিম কোর্টের। সে জন্য লিখিত সংবিধানের দেশে সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। তবে আমরা চাইব যে, বিচারপতি, সাংসদসহ সকলেই সহনশীল হবেন এবং সংযত আচরণ করবেন। তাদের কথাবার্তা হবে দায়িত্বশীল ও আইনসম্মত। নইলে গণতন্ত্রও হোঁচট খাবে, সাংবিধানিকতাও শক্ত ভিত্তি পাবে না।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই প্রথম আমরা সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টকে মুখোমুখি হতে দেখলাম। এতে আতঙ্কিত বা আশঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। কেননা সুস্থ গণতন্ত্রের দেশে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগ বা সংসদের নানা সময়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে। সেসব দ্বন্দ্বের ফলে সংবিধানের আরও ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে, সাংবিধানিকতার বিকাশ হয়েছে এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী ভিত্তি পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস কর্তৃক পাস করা আইনের বৈধতা যাচাই করতে পারে কিনা, নির্বাহী বিভাগের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারে কিনা, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। পরিশেষে ১৮০৩ সালে প্রধান বিচারপতি মার্শাল মারবারি বনাম মেডিসন মামলায় (গধৎনঁৎু া গধফরংড়হ, (১৮০৩), ১ ঈৎধহপয, ১৩৭) বলেন যে, সুপ্রিম কোর্টের 'জুডিসিয়াল রিভিউ'র ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট সংসদ কর্তৃক পাস করা আইন ও নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ডের বৈধতা যাচাই করতে পারবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সংবিধানের মৌল কাঠামো নীতি ও সংসদের আইন প্রণয়নের সীমা বিষয়ে গোলকনাথ ও কেশবানন্দ ভারতীর মামলায় আমরা সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে গুরুতর দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। আমার কথা হচ্ছে, সুস্থ গণতন্ত্রের একটা দেশে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে পারে, এটা অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অনেক সময়ই এসব দ্বন্দ্বের ফলাফল নেতিবাচক হয়নি। বরং তা ছিল সাংবিধানিকতার বিকাশে সহায়ক। গণতন্ত্রকেও তা শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছে।

শেখ হাফিজুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hrkarzon@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.