মাদক ও বৈদেশিক মুদ্রা চোরাচালান একাকার-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চিঠি চালাচালি চলছে by আবুল কাশেম

বাংলাদেশ থেকে যতগুলো কারণে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয় ভারতে, এর মধ্যে একটি বড় কারণ হলো মাদক। ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য আসছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে। এ চোরাচালান সম্প্রতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে।


ভারত এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে নালিশ করেছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) সহযোগী সংস্থা জার্মানিভিত্তিক ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব শুল্ক সংস্থার কাছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এবং রাজস্ব বোর্ড বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালককে সীমান্তে বৈদেশিক মুদ্রা ও মাদক পাচার রোধে উদ্যোগ নিতে চিঠি দিয়েছে। এরপর বিজিবি সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বিজিবি এসব তথ্য সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পুরো বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়েই অর্থাৎ ভারত, মিয়ানমার বা এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে মাদক ঢুকছে দেদার। শুধু ভারত থেকে আসা এসব মাদকের মূল্য পরিশোধ করতেই বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধভাবে পাচার করতে হচ্ছে। অন্যান্য পণ্য চোরাচালান করতেও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যানুযায়ী, সীমান্তের ৪৬টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে মাদক ঢুকছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে বাস, ট্রাক, মাছ ধরার নৌকা এমনকি বিমানে করেও নানা কৌশলে ঢুকছে ফেনসিডিল। এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক ব্যুরোর ২০১২ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল নারকোটিক্স কন্ট্রোল স্ট্র্যাটেজি রিপোর্টে (আইএনসিএসআর) বলা হয়েছে, ২০০৯ ও ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত নানা জরিপ তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশপথের নিরাপত্তা এতই ভঙ্গুর যে সহজেই এ দেশের ভেতর দিয়ে মাদক পাচার করা যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চোরাচালান নিরোধ কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের এক কর্মকর্তা জানান, ভারতের শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার কমিশনার চিত্রা শর্মা সম্প্রতি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের কাস্টমস অ্যান্ড পিআরমন্ত্রী প্রকাশ দেওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের মাত্রা, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
চিত্রা শর্মার এ অভিযোগের ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের মন্ত্রী প্রকাশ দেওয়ান গত ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান মো. ইকবালের কাছে একটি ই-মেইল করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানের মাত্রা, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান কার্যক্রম রোধ এবং চোরাচালানের রুট ও এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত অবৈধ অর্থের উৎস খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশ শুল্ক গোয়েন্দার সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।'
ই-মেইলটি পাওয়ার পর বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান মো. ইকবাল রাজস্ব বোর্ডের চোরাচালান নিরোধ কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, 'এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় হচ্ছে এবং এসব স্থানে বিজিবি সক্রিয় রয়েছে। তাই চোরাচালানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা, মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য পণ্য যাতে এ দেশে আসতে ও ভারতে যেতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি/মনিটরিংসহ আরো গতিশীল কার্যক্রম ও তৎপরতা বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও মাদক চোরাচালান রোধ, চোরাচালানের রুট এবং এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত অবৈধ অর্থের উৎস খুঁজে বের করার জন্য ভারতের কাস্টমস ইনটেলিজেন্সকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।'
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সীমান্তে মাদকদ্রব্য ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বেড়ে গেছে উল্লেখ করা এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্ব বোর্ড থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের আরো সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।' সীমান্তে চোরাচালান দমন করা কেবল বিজিবি নয়, ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীরও দায়িত্ব বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান মো. ইকবাল বলেন, 'সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আসে। এসব মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন চোরাই পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতেই বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে। ব্রাসেলস থেকে আমাকে পাঠানো ই-মেইলটিসহ এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য আমি রাজস্ব বোর্ডকে জানিয়েছি।' তিনি বলেন, সীমান্তে এ ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ শুল্ক গ্রুপ (জয়েন্ট গ্রুপ অব কাস্টম) রয়েছে। এ গ্রুপ বছরে দুইবার বৈঠকও করছে।

No comments

Powered by Blogger.