পাকিস্তান-বৈষম্য ও বৈপরীত্যের দেশ by ইসরাত জাহান

করাচির রাস্তায় সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে হাঁটছি আমরা ১০ বাংলাদেশি। দুপুরে মাত্র পা রেখেছি পাকিস্তানে। নানা প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে আর অতীত অভিজ্ঞতায় মন আর মাথা ঠাসা ছিল নেতিবাচক অনুভূতিতে। সাংবাদিক হওয়ায় হয়তো নিজের অজান্তেই এসব পূর্বধারণাকে পাশে ঠেলে সবকিছু খোলামনে দেখার একটা আকাঙ্ক্ষাও ছিল।


তার পরও সতর্ক ছিলাম—করাচি বলে কথা! হঠাৎ আমাদের দলেরই একজনকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কিছু বলতে দেখে সবাই কী হলো, কী হলো করে উঠি। তাঁর দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকাই। চোখে পড়ে দাড়ি-গোঁফওয়ালা এক পাকিস্তানি বৃদ্ধের হাসিমাখা মুখ। আমাদের সহযাত্রী জানান, বৃদ্ধ আমাদের দেখে উৎসুক অন্যদের বোঝাচ্ছিলেন, আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। সবাই তখন আমরা একযোগে বৃদ্ধকে বোঝাতে লেগে যাই: হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা বাংলাদেশি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের আমরা এ দেশ থেকে বিতাড়িত করেছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আমরা বাঙালি। যেখানেই যাই—এ আমাদের বড় অহংকার। কিন্তু পাকিস্তানি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে দেখা যায়, তারা জানেই না মুক্তিযুদ্ধে তাদের শাসকদের নৃশংসতার কথা, পরাজয়ের কথা। কিন্তু এখন যখন জানছে, প্রত্যেকেই ঘৃণা জানাচ্ছে শাসকদের এই কর্মকাণ্ডের প্রতি, প্রকাশ করছে লজ্জা। আজ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে শুধু দেশের ভেতরেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণের লড়াই করতে হচ্ছে তা না। করতে হচ্ছে বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি উন্নত করার লড়াইও।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে গত ১৬ মে আট দিনের সফরে দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের ১০ জনের। প্রচারমাধ্যম নয়, স্বচক্ষে পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ করে দেওয়াই ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য। বাইরে থেকে হঠাৎ গিয়ে কোনো দেশের প্রকৃত অবস্থা বুঝে ওঠার সুযোগ থাকে খুবই সীমিত। এই সীমিত সুযোগ থেকেই যেমন পাকিস্তানি আতিথেয়তা, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, শহরাঞ্চলে নারীদের স্বচ্ছন্দ চলাফেরা, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা নজর কাড়ে, তেমনি চোখে পড়ে দেশটির মানুষের জীবনযাত্রায় বৈপরীত্য, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, নিরাপত্তার ঝুঁকি আর সামরিক শক্তির দিকেই শাসকদের মনোযোগের বিষয়টি। এখানকার প্রধান তিনটি নগরের পথে চলতে গিয়ে যেটুকু দেখা আর মাঝেমধ্যে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাই এ লেখার সম্বল।
কোনো দেশের উন্নয়নে যোগাযোগব্যবস্থার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক, বেসামরিক সব শাসকই এই যোগাযোগব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন। করাচি পাকিস্তানের পুরোনো শহর। তার পরও এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা এত ভালো যে করাচি বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ৭০-৮০ কিলোমিটারের মধ্যে যানজট তো দূরের কথা, একটা ট্রাফিক সিগন্যালের বাধাও আপনি পাবেন না। ছুটে চলা রাস্তায় কেবলই চোখে পড়ে প্রাইভেট কার আর মোটরসাইকেল। রয়েছে স্কুটার আর আমাদের মুড়ির টিনের মতো কিছু বাসও। এগুলোর জানালায় চোখে পড়ে দরিদ্র মানুষের মুখ। তবে করাচির কোথাও দেখবেন না এসব মানুষের বসবাস। শহরে এরা আসে জীবিকার তাগিদে। দিন শেষে ফিরে যায়।
এটাও সত্য, কোনো বাসেই মানুষকে দাঁড়িয়ে বা ঝুলে যেতে দেখা যায় না। অথচ পাকিস্তানের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৭০ লাখের মতো। আয়তন আট লাখ তিন হাজার ৯৪০ বর্গকিলোমিটার। আর শুধু করাচিতেই থাকে দেড় কোটির বেশি মানুষ।
লাহোরের রাস্তায় করাচির সেই মুড়ির টিনের মতো বাস নেই। বরং চোখে পড়তে পারে নিরিবিলি রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কোনো গাধা। এখানে শহর ঘিরে পাহাড় থাকায় পাহাড়ি পথে চলতে অভ্যস্ত গাধা বা ঘোড়া কখনো দুলকি চালে শহরের রাস্তায়ও নেমে আসে। ইসলামাবাদে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে দেখা গেল ব্যস্ত গাড়ির গতি অক্ষুণ্ন রাখতে। কদাচিৎ যদি কোনো সিগন্যালে গাড়ি থামে তবে তার জানালায় এসে হাত পাতে কঙ্কালসার চেহারার কোনো নারী বা শিশু। শহুরে পাকিস্তানিদের জীবনে এরা যেন বিচ্ছিন্ন আরেক জগতের মানুষ। অথচ দেশটির বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। বেনজির ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রামের (বিআইএসপি) হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে। এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ আবার চরম দরিদ্র।
করাচি, লাহোর আর ইসলামাবাদে ফুডস্ট্রিট বলে কয়েকটি রাস্তা আছে। এক নামেই সবাই চেনে এসব জায়গা। এখানে সন্ধ্যার দিকে নারী-পুরুষ ভিড় করে খোলা রাস্তায় মুক্ত বাতাসে আহার করতে। লাহোরে প্রথম একটি ফুডস্ট্রিট গড়ে তোলা হয়। পরে গড়ে তোলা হয় ইসলামাবাদ ও করাচিতেও। কোনো অনুষ্ঠান বা প্রাত্যহিক—দুই ধরনের প্রয়োজন থেকেই এখানে খেতে আসে মানুষ। বন্ধু, পরিবার, সন্তানসন্ততি নিয়ে দলবলে বা একা। ভোজনবিলাসী সচ্ছল মানুষেরা এখানে হইহুল্লোড় করে, আড্ডা দিয়ে ফেরে ঘরে।
ইসলামকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা। অথচ তাদেরই রাস্তায় প্রকাশ্যে দেখা যায় বিশাল বিলবোর্ডে বিয়ারের বিজ্ঞাপন। যে ভারতের সঙ্গে রেষারেষি করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাজেটের মূলভাগ ব্যয় করে সমরাস্ত্রের পেছনে, বাড়িয়ে চলে পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষমতা, সেই ভারতীয় সিনেমা আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের ব্যবসা এখানে রমরমা। এখানে মানুষ কাজ শেষে নাইট শোতে দেখতে যায় সিনেমা হলে চলা ভারতীয় সিনেমা।
করাচির রাস্তায় পা রেখে শুরু হয়েছিল পাকিস্তান দেখা। পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নগর হিসেবে করাচির যে পরিচিতি, সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম সিন্ধু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কিয়াম আলী শাহর কাছে।
১৮ মে তিনি নিজ বাসভবনে বসে সফরকারী দলটিকে বলেন, ‘দেখুন, করাচিতে দেড় কোটি মানুষের বাস। আয়তন ও জনসংখ্যার এই অনুপাতকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কোনো শহরের সঙ্গেও তুলনা করেন, তবে করাচির অবস্থা অনেক ভালো।’ শহরটির অনেক প্রবীণ সাংবাদিকও মনে করেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এগুলো পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্যমূলক ‘মিথ্যা প্রচারণা’। মুখ্যমন্ত্রী কিয়াম আলী শাহ সেদিন আরও দাবি করেছিলেন, করাচির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অথচ ২৪ মে আবার করাচির বুক হয়েই আমরা যখন ফিরছি, জানতে পারলাম শহরটিতে হরতাল। তাই নিরাপত্তার খাতিরে স্থানীয় পিআইএর হোটেলেই সারা দিন বসে থাকতে হলো। সেখানেই চলে নানাজনের সঙ্গে গল্পগুজব। তারা আমাদের জানায়, বেলুচরা এসেছিল। তারেক রোডে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়েছে। তাই হরতাল। মনে পড়ে, এই সেই ‘তারেক রোড’, যেখানে বৃদ্ধ পাকিস্তানি প্রথম দিন আমাদের ভাই বলে ডেকেছিলেন।
ইসরাত জাহান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.