কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-কেন না কহেন কথা আমার সঙ্গে by রণজিৎ বিশ্বাস

'মান না মান হাম তেরা মেহমান'- কথাটা শুনেছেন? : শুনব না কেন, কতবার কতভাবে কত আসরে কতজনের কাছে কতজনের জন্য ও কতজনের বিষয়ে প্রয়োগও তো করেছি। : কথা বড় লম্বা করেন আপনি। : কারণ আছে। : কী কারণ?


: আমি কথার বড় টানে পড়ি। কথা আমার পুঁজিতে পাট্টায় বড় বেশি থাকে না।
: কথাটার অর্থ কী?
: 'মান না মান হাম তেরা মেহমান' যে ভাষার কথা, সে ভাষায় কোনো অধিকার না থাকলেও বোঝা যায়। আপনি আমাকে আহ্বান করুন না করুন, ডাকুন না ডাকুন, নিমন্ত্রণ দিন না দিন; আমি আপনার বাড়িতে ভাত খাব। এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে, ভাত কিন্তু সব তরকারিতে খাব না; ভাত খাব অন্য তরকারিতে! ব্যবস্থা রাখবেন।
: এমন অদ্ভুত অবস্থা এখন কি কোথাও দেখা যাচ্ছে?
: যাচ্ছে মানে! এমন অবস্থার ভেতরেই তো আমরা আছি। এর ভেতরে থেকে এবং এমন কথা শুনে শুনেই তো আমরা দিন পার করছি।
: কোথায় এমন অবস্থা, একটা-দুটো দেখিয়ে দিন না।
: আমাকে দেখাতে হবে কেন? আপনি কান পাতলেই তো শুনতে পান! চোখ পাতলেই তো দেখতে পান।
: ঠিক আছে, চোখ পেতে দেখে নেব, কান পেতে শুনে নেব।
: এবং মন ঢেলে বুঝে নেবেন।
: তা-ও নেব। এখন আপনি বলুন, আপনি আমার সঙ্গে বলেন না কেন?
: আমি বলতে চাই। চেষ্টাও করি, কিন্তু বলতে আমার ভালো লাগে না। নিজেকে আমি প্রস্তুত করতে পারি না। বারবার আমি পিছিয়ে পড়ি। বারবার আমি ভয় পাই।
: ভয় পান কেন? আমার দাঁত আছে না নখ আছে!
: শুধু তা থাকলে তো হতো! আপনার নখের গোড়া ছেঁটে দিতাম। আপনার ডার্টি হলুদ দাঁতগুলো সব উপড়ে দিতাম। আপনার দাঁতে দাঁতে বিষ আছে, আপনার আঁতে আঁতে পয়জন আছে, আপনার নখে নখে ময়লা আছে, আপনার মনের ভেতর কালি আছে, আপনার মাথার ভেতর ষড়যন্ত্র আছে, আপনার চারপাশে গোবর আছে। সে কারণেই আপনাকে নিয়ে আমার ভয় আছে।
: তাই বলে কি কথা বলবেন না?
: বললাম তো, পারি না। আপনাকে দেখে কথা আমার হারিয়ে যায়।
: আমাকে নিয়ে আপনি এত ভয়ে থাকেন?
: ভয়ে নয়, বিবমিষায়। আমাকে দেখার পর আমার যে অবস্থা হয়, কাঁচা কাঁচা পুরুষ দেখেও তা হয় না। আমি আপনার মতো ইউনিক জিনিস দেখিনি।
: বুঝিয়ে না বললে বুঝব কী করে?
বুঝতে না পারলে শুধরোব কী করে?
: বুঝতে আপনি কখনো পারবেন কি না সন্দেহ হয়।
: আমার সব বিষয়েই তো আপনার সন্দেহ।
: হাজার-একটা কারণ আছে।
: দু-চারটা তো বলুন।
: বললে তো বলতে পারি, কিন্তু বলব কেন? বলে কী লাভ! আপনি তো বদলাবেন না। সে বয়সও আপনার নেই, সে ইচ্ছাও আপনার নেই, সে প্রয়োজনীয়তা আপনার আছে- এটিও আপনি মনে করেন না।
: আপনার ওপর আপনার ক্ষোভের কারণ বলা আপনি কিন্তু এখনো শুরু করেননি।
: শুরু করা যাবে, তবে শেষ করা যাবে না। আপনার অপরাধের তালিকা চির অনিঃশেষ এক ভ্রমণরেখা। আপনার বিরুদ্ধে আমার ক্ষোভ একটির চেয়ে অন্যটি ভয়াবহ। আপনি আমাকে বারবার মেরে ফেলতে চেয়েছেন, এই কাজে বারবার আপনি অমানুষ নিয়োগ করেছেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করতে ভালোবাসেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী ও মানবতাবিরোধীদের আপনি দুই বাহুর মাঝখানে ঠাঁই দেন। যারা মানুষকে মানুষ মানার আগে তার জন্মপরিচয় নিয়ে রিসার্চ করে, সেই রিসার্চের ফল টেবিলে বসে বানায় এবং সেই ফলের ওপর ভর করে কাউকে ওঠায় কাউকে নামায়, কাউকে ডোবায় কাউকে ভাষায়- আপনি তাদের পক্ষে ওকালতি করেন। এবার আপনিই আমাকে বলুন, আপনার সঙ্গে কথা আমি কী করে বলব! আপনাকে দূরে না রেখে ও আপনার থেকে দূরে না থেকে আমার উপায় কী!
লেখক : শ্রমজীবী ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.