জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-আমাদের লোহানী ভাই by আসাদ চৌধুরী

'কামাল লোহানী আজীবন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছেন। তাঁর এ অবদানের কথা আমার বিবেচনায় দলমত-নির্বিশেষে সবাই সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবেন। কামাল লোহানীর মতো সাংস্কৃতিক যোদ্ধা বিরল আমাদের দেশে।


আজও এই সংগ্রামী, প্রগতি ও কল্যাণের সাধক মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে; তাঁর মাথা নত হচ্ছে না কোনো লোভ বা ক্ষতিকর সংস্থার কাছে। যেখানে সংগ্রামী জনগণের মিছিল, যেখানে প্রগতির আহ্বান, মানুষের মুক্তির আন্দোলন- সেখানেই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি, সেখানেই তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বান, কবিতার আবৃত্তির সুর। তাই মিছিলে, শহীদ মিনারে, প্রগতিশীল শক্তির সম্মেলনে কামাল লোহানীর দৃপ্ত পদধ্বনি উজ্জ্বল, উদাত্ত কণ্ঠস্বর।' (সংস্কৃতি হলো সমাজ বদলের হাতিয়ার, সম্পাদক : মুজতবা আহমদ মুরশেদ, ২০০৩, ক্রান্তি, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫)।
উপায় ছিল না- কবি শামসুর রাহমানের আবেগ-আক্রান্ত এই উচ্চারণ আমারও, বলা ভালো, এত কষ্ট করে আমি বলতেই পারতাম না। তাই উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করতে হলো।
১৯৫৫ সাল থেকেই সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। মিল্লাত, আজাদ, সংবাদ, পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট হয়ে ১৯৬৭-তে দৈনিক পূর্বদেশের শিফট ইনচার্জ। এ সময় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আমি সে সময় পূর্বদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংবাদদাতা ছিলাম, অবজারভার হাউসে আমাকে যেতে হতোই।
রবীন্দ্র শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অভিজ্ঞতা আবারও এ দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিল, মর্মান্তিক সত্য যে ওরা এ দেশের নয়। ছায়ানটের জন্ম হলো সমমনাদের নিয়ে। সন্জীদা খাতুনের লেখায় জানতে পারি ছায়ানট করার জন্য তাঁকে কী ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। একপর্যায়ে লোহানী ভাইকে সাধারণ সম্পাদকের (১৯৬২-৬৫) দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। পরে ১৯৬৭-র দিকে তিনি ক্রান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রান্তি শুধু যে ঢাকায় অনুষ্ঠান পরিবেশন করবে তা নয়- দেশের দূর-দূরান্তে, কৃষক সমাবেশে, শ্রমিক সমাবেশেও ক্রান্তির নৃত্যনাট্য 'জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে', নাটক 'আলোর পথযাত্রী' গীতিনকশা 'ধানের গুচ্ছে রং জমেছে' শ্রোতাদের শুধু আনন্দই দিত না, সজাগ, সচেতন হতে সাহায্য করত। এই ক্রান্তির ব্যাপারেই আমাকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল ১৯৬৮-তে, সম্ভবত ডিসেম্বরের দিকে, আমাকে টেলিগ্রাম করে আনা হয়েছিল, হয় রাশেদ খান মেনন, নয় হায়দার আকবর খান রনো- আমার দুই বন্ধুর একজন আমাকে টেলিগ্রাম করে ঢাকায় আনিয়েছিলেন, আর অবাক করে দিয়ে আমাকে একজন সহসভাপতিও করা হলো।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়লে কী হয়, সে তো আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গান চলছে, হঠাৎ গান থামিয়ে দিয়ে আখাউড়া সেক্টরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপর্যয়ের টুকরো খবর, আবার তার পরই পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে- সংবাদ যে উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে, ওয়ার প্রপাগান্ডা যে কত উঁচু স্তরে পৌঁছতে পারে, সে সময় আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি।
১৯৭৩-এর ২০ জানুয়ারি তিনি নতুন পত্রিকা জনপদের বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। গাফ্ফার ভাই সম্পাদক। তিনি আমাকে খবর পাঠালে আমি লিডার রাইটার পদে ১ ফেব্রুয়ারি জনপদে যোগ দিই। এই প্রথম লোহানী ভাইকে সহকর্মী হিসেবে পাই এবং গর্ব অনুভব করি। হাসি-খুশি-আনন্দময় মানুষটি কিন্তু কারো গাফিলতি সহ্য করতেন না। লোহানী ভাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন, পরের বছরও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। চুয়াত্তরে তিনি বঙ্গবার্তায় যোগদান করেন। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাংলার বাণীতে যোগদান করেন।
আজ লোহানী ভাইয়ের ৭৯তম জন্মদিন। তাঁর জন্মদিন ছিল বাংলা ১১ আষাঢ়। লোহানী ভাইয়ের দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের সমৃদ্ধ করে চলেছে। তিনি আমাদের দেশ ও জাতির সামনে আলো হয়ে আরো অনেক দিন জ্বলে থাকুন। তাঁর জন্মদিনে এটাই প্রত্যাশা।
আসাদ চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.