সমকালীন প্রসঙ্গ-জমি, লেক, নদী দখল ও কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া by বদরুদ্দীন উমর

এখানে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, উৎপাদন খাতে কালো টাকা সাদা করে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা যা-ই থাক, এই টাকার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি হতে থাকা এবং এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা বা তার ব্যাপকতা কমিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থাই ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই করেনি।


এর কারণ প্রথম থেকেই বাংলাদেশে দুর্নীতির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সে অনুযায়ী একে দমন বা খর্ব করার কোনো পাল্টা প্রক্রিয়া এখানে গড়ে ওঠেনি। কাজেই ১৯৭২ সালে যার
শুরু আজ তার ভয়াবহ রূপই দেখা যাচ্ছে

গুলশান লেকসহ ঢাকার বিভিন্ন লেক ও জলাভূমি সরকারি সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে ক্ষমতাসীন লোকদের দ্বারা সরকারি সহায়তায় লুটপাট হচ্ছে এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ আমলে ১৯৭১-এর পর থেকেই প্রথমে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এবং পরবর্তীকালে তারই ধারাবাহিকতায় প্রত্যেকটি সরকারের আমলে একই কায়দায় এই লুটপাট অব্যাহত আছে। আজ (২৫.৬.২০১২) ঢাকায় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে এর ওপর একটি সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রিকাটি পরিবেশ বিষয়ে প্রত্যেক বছরই অসংখ্য এ ধরনের সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ করে। শুধু ঢাকার লেকের ওপরই নয়, বুড়িগঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী চারটি নদী দখলের ওপরও ডেইলি স্টার নিয়মিতভাবেই বছরের পর বছর রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু এর কোনো ফলাফল দেখা যায় না। বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে এদিক দিয়ে কোনো পরিবর্তন হয় না।
বাংলাদেশে কালো টাকা নিয়ে অনেক খেলা হয়। বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী এ বছরও ২০১২-১৩ সালের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নিয়মকানুন সবিস্তারে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার মতে, কালো টাকা খারাপ কিছু নয়। আসলে এটা হলো এক ধরনের 'অপ্রদর্শিত আয়'।
এ প্রসঙ্গে তিনি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের কথাও বলেছেন। সরকারি খাস জমি ও জলাভূমি দখল করে যারা লুটপাটের কারবার করছে তাদের এভাবে অর্জিত টাকাপয়সাকে অর্থমন্ত্রী 'আয়' হিসেবে বর্ণনা করে এই 'অপ্রদর্শিত আয়'কে জাতীয় অর্থনীতির স্রোতে টেনে আনার জন্যই কালো টাকা সাদা করার পন্থা নির্দেশ করেছেন!
এ কথা ঠিক যে, কালো টাকা নামে কথিত টাকা লুকিয়ে না রেখে বা বিদেশে চালান না দিয়ে দেশে উৎপাদনের খাতে ব্যয় করলে সেটা দেশীয় অর্থনীতির জন্য লাভের ব্যাপার। কিন্তু অন্যদিকে এভাবে সম্পদ অর্জনকারী লোকদের লঘুভাবে 'শাস্তি' দিয়ে কালো টাকা সাদা করার যে পন্থা তিনি বের করেছেন, তাতে দেশে ক্রমবর্ধমানভাবে কালো টাকার পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করা ছাড়া অন্য কিছু হবে না। যেহেতু বাংলাদেশে কালো টাকা উপার্জনের অন্যতম প্রধান পথ হচ্ছে জমি ও জায়গা দখল, সেখানে এভাবে কালো টাকা অতি সহজে সাদা করতে উৎসাহ দেওয়ার অর্থ অবাধে সরকারি জমি ও জলা লুটপাটে পরোক্ষ সহায়তা করা ছাড়া আর কী?
যাই হোক, আমরা আমাদের ডেইলি স্টারের রিপোর্টে ফিরে এসে দেখতে পাচ্ছি যে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গুলশান লেক থেকে নিয়ে অন্যান্য জমি ও জলাশয় দুর্বৃত্তদের দ্বারা লুটপাটের এক সহায়ক শক্তিতেই প্রকৃতপক্ষে পরিণত হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে রাজউক হাইকোর্টের নির্দেশ পর্যন্ত বেপরোয়াভাবে অমান্য করতে অসুবিধা বোধ করছে না। এর কারণ, এই ভূমিদস্যুরা কোনো দুর্বল শক্তি নয়। তারা সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং প্রভূত ধনসম্পদের মালিক। তাছাড়া দেখা যাচ্ছে যে, হাইকোর্ট একটা নির্দেশ দিলে সে নির্দেশ যদি মান্য করা না হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। অন্য অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করলে যেখানে আদালত অবমাননার জন্য তারা যে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে তার কিছুই হচ্ছে না। রাজউক এবং বেআইনিভাবে লেক দখল করা লোকেরা হাইকোর্টের নির্দেশ অবহেলার সঙ্গে অগ্রাহ্য করে বেশ নিশ্চিন্তই আছে এবং নিজেদের লুণ্ঠন বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই অব্যাহত রেখেছে। এই লুণ্ঠনকারীরাই আজ বাংলাদেশের জিডিপির ৪০% থেকে ৮০% অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে বলে অর্থমন্ত্রী নিজেই তার বাজেটে উল্লেখ করেছেন! এই সঙ্গে তাদের কালো টাকা সাদা করার 'মহান' লক্ষ্যই তিনি তার বাজেটে নির্ধারণ করেছেন! কিন্তু যেহেতু এই জমি ও জলা দখলকারীরা সরকারের সঙ্গে যুক্ত এবং দেশের ধনিকশ্রেণীর সব থেকে শক্তিশালী অংশ, এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের পর্যন্ত করার কিছু নেই! কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থাও তারা গ্রহণ করতে পারেন না।
এভাবে জমি বা জলাভূমি ইচ্ছামতো দখল করে বাড়িঘর তৈরি করলে শুধু যে সরকারি সম্পত্তি বা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের দখলে চলে যায় তাই নয়, এর ফলে আরও ক্ষতিকর যে ব্যাপার হবে সেটা হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এই পরিবেশ দূষণ বহুদিন ধরে ঢাকায় জমি, জলা ও নদী দখলের কারণে ঘটছে। এই দূষণ ঘটছে নদীগুলোর পার্শ্ববর্তী কারখানা থেকে দূষিত বর্জ্য পদার্থ নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে।
এটা বোঝার কোনো অসুবিধা নেই যে, দেশের প্রশাসন যদি এই লুটপাটের সঙ্গে সম্পর্কিত না থাকে, যদি এই লুণ্ঠনের অংশীদার না হয় তাহলে লুটপাট যে হারে চলছে এটা সম্ভব হতে পারে না। রাজউক যে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে দখলকারীদের পক্ষে কাজ করছে এটা উভয়ের মধ্যে লেনদেন ছাড়া অসম্ভব। এই লেনদেন সম্ভব হচ্ছে উচ্চতর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা ও সমর্থনে। এই লুটপাটের ভাগ তাদের পাতেও পড়ছে। প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদির শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে যেমন চেইন অব কমান্ড বলে একটা জিনিস আছে, তেমনি এখানে দুর্নীতির ক্ষেত্রেও একটা চেইন আছে! এই 'চেইনে'র মাহাত্ম্যে নিচের তলার দুর্নীতির ভাগ ওপরতলা পর্যন্ত পেঁৗছে যায়!
বাংলাদেশে জমি দখল অব্যাহত রয়েছে এবং জমির দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কলকাতা, দিলি্ল, লন্ডন, নিউইয়র্কের জমির দাম থেকে এখানকার জমির দাম এখন বেশি।
জমির মূল্য এভাবে বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, সারা বাংলাদেশই এখন ঢাকামুখী। এ কারণে দেখা যায় যাদের শুধু গ্রামে নয়, জেলা সদরেও নিজেদের বাড়ি আছে তারাও ঢাকায় একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য আগ্রহী ও ব্যস্ত। এটা মনে হয়, সামাজিক মর্যাদার সঙ্গেও এখন সম্পর্কিত হয়েছে। যে জন্য মফস্বল শহরে যত বড় বাড়িই থাক, ঢাকা শহরে বাড়ি নেই এটা ধনী লোকদের সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়! কাজেই ঢাকায় তারা বাড়ি কেনে। এর জন্য জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি হয়। এ ছাড়া আছে প্রবাসে চাকরি ও ব্যবসা করা লোকজন। তারা ঢাকায় বাড়ি কেনার জন্য ব্যস্ত। এই প্রবাসীদের বাড়ি কিনতে আগ্রহী বা প্রলুব্ধ করার জন্য এখানকার নির্মাণ ব্যবসায়ীরাও নানা রকম ফাঁদ পেতে, সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন দেয়। এতে কাজ হয়। ঢাকা এবং এর আশপাশ এলাকায় অসংখ্য হাউজিং সোসাইটি এখন আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। এর ফলে সে জমির দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে এবং জমি বেআইনিভাবে দখলের প্রক্রিয়া ব্যাপক ও শক্তিশালী হবে এটাই স্বাভাবিক।
জমি দখল, জমি ও বাড়ি কেনা, আবাসিক ভবন নির্মাণ এবং আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা_ সবকিছুই এখন কালো টাকা উপার্জন এবং কালো টাকা বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত আছে। বেশ বড় আকারে এই কারবার চলতে থাকার কারণেই জিডিপির এত বেশি পরিমাণ কালো টাকার বৃত্তভুক্ত হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কালো টাকা 'উপার্জনের' সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৩ সালের মধ্যে কালো টাকা অর্থনীতিতে এমন স্থান অধিকার করেছিল যে, তখনই সরকার কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা সরকারিভাবেই ঘোষণা করেছিল। সে ক্ষেত্রেও এই একই যুক্তি ছিল। কালো টাকা অপচয় হতে না দিয়ে বা বিদেশে পাচার হতে না দিয়ে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হওয়া দরকার। এটা কালো টাকা সাদা করা ছাড়া সম্ভব নয়।
এখানে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, উৎপাদন খাতে কালো টাকা সাদা করে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা যা-ই থাক, এই টাকার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি হতে থাকা এবং এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা বা তার ব্যাপকতা কমিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থাই ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই করেনি। এর কারণ প্রথম থেকেই বাংলাদেশে দুর্নীতির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সে অনুযায়ী একে দমন বা খর্ব করার কোনো পাল্টা প্রক্রিয়া এখানে গড়ে ওঠেনি। কাজেই ১৯৭২ সালে যার শুরু আজ তার ভয়াবহ রূপই দেখা যাচ্ছে। এ কারণে অর্থমন্ত্রীর বাজেটে শুধু যে কালো টাকার নতুন সংজ্ঞা নির্দেশ করে একে 'অপ্রদর্শিত আয়' আখ্যা দিয়ে সম্মানজনক করার চেষ্টাই হয়েছে তাই নয়, কালো টাকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থাই এই বাজেটে নেই! সরকারের কোনো পরিকল্পনাতেই নেই! এই পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করে যে রাজউক কর্তৃপক্ষ লুটপাটকারী ক্রিমিনালদের পক্ষেই কাজ করবে এ ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যাশারও কোনো যুক্তি নেই। দুর্নীতির যে অখণ্ড রাজত্ব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও জারি আছে, তার সরকারি স্বীকৃতি অর্থমন্ত্রীর বাজেটে বেশ খোলাখুলিই আছে। কাজেই সমগ্র প্রশাসন ও শাসন প্রক্রিয়াই এখন আইনের শাসনবহির্ভূত হয়ে দুর্নীতির তাগিদ অনুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান শাসকশ্রেণী ও তার সৃষ্ট দুর্নীতির সংস্কৃতি যতদিন পূর্ণ গৌরবে বাংলাদেশে রাজত্ব করবে ততদিন জমি, জলা, নদী, এমনকি সমুদ্র দখল প্রক্রিয়া রোধ বা প্রতিরোধের কোনো সম্ভাবনা যে নেই এটা বলাই বাহুল্য।
২৫.৬.২০১২
 

No comments

Powered by Blogger.