চারদিক-আমিনাবাদবাসীর বিশেষ দিন by নেয়ামত উল্যাহ

অগ্রহায়ণেও বর্ষা! সঙ্গে ঝড়ও। বলছি ১৯ নভেম্বরের কথা। ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন। বাংলাদেশিদের জন্য কিংবা ভোলাবাসীর জন্য এটা কোনো বিশেষ দিন নয়। এমনকি চরফ্যাশন উপজেলাবাসীর জন্যও নয়। তবে ওই উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নবাসীর জন্য এটি বিশেষ দিন।


এ দিনে বৃষ্টি-ঝড় কামনা করে না, করে রৌদ্রকরোজ্জ্বল আলোকিত দিন, গরম-ঠান্ডার মিশেল বাতাস। এই দিনটির জন্য তারা মুখিয়ে থাকে। ছাত্ররা সারা বছর পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে ভালো ফল করার জন্য। সারা বছর জন্মস্থানের মুখ না-দেখা লোকটি ওই দিন বাড়িতে আসে—দিনটিকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করবে, এ আশায়।
সংসারে মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আমরা একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে পছন্দ করি। মা ও স্বজনেরা অপেক্ষা করে ছেলে বা মেয়ে কখন আসবে ঈদের ছুটিতে। এখানে পুরো ইউনিয়নবাসী অপেক্ষা করে, কবে আসবে ওই দিন। একত্রে আনন্দ করা, একত্র জমায়েত হয়ে কোলাকুলি। কুশল বিনিময়। মিষ্টি মুখ। দিনব্যাপী থাকে ঈদ আনন্দ। এ যেন ঈদ পুনর্মিলনী মেলা।
ভোলা সদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চরফ্যাশনের আমিনাবাদ ইউনিয়ন। ঐতিহ্যে ও ইতিহাসে ভরা, ছায়াঘেরা, পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর এলাকা। স্বনামধন্য বিপুল গুণী মানুষ জন্মেছেন এ ইউনিয়নে। মাঠ ভরা থাকে সারা বছর সবুজ-সোনালি ফসলে। পিচঢালা সড়ক দিয়ে পুরো ইউনিয়ন ঘুরলে দুঃখী মন অনায়াসেই ভালো হয়ে যায়। যেন পটে আঁকা ছবি। এই গুণী মানুষেরা দেশে যেমন আছেন, তেমনই বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। ২০০৫ সালে ওই প্রবাসীরা গঠন করেন আমিনাবাদ প্রবাসী কল্যাণ সমিতি। ওই বছর থেকেই সমিতির প্রধান কাজ হলো, বছরে এক দিন পুরো ইউনিয়নবাসীকে একটি স্থানে একত্র করা। ওই দিনটি হলো ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন। এ দিনে কৃতী ছাত্র ও শিক্ষকদের পুরস্কৃত করা হয়। সমিতির সভাপতি আবদুল বারেক বলেন, ‘প্রথম বছর আমরা কৃতী ছাত্রছাত্রী পেয়েছিলাম ৫২ জন। এ বছর সেটা ১৪২ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি স্কুলে প্রাথমিক, জুনিয়র বৃত্তি ও জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। খেলাধুলায় ছাত্ররা উৎসাহিত হচ্ছে। যেসব স্কুল ভালো ফল করছে, আমরা ওই স্কুলের শিক্ষকদের ও কৃতী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কৃত করি। ইউনিয়নে যে কেউ অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হলে তাকে আমরা দেশে-বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাই। দেশ-বিদেশের কোথাও আমিনাবাদের মানুষ মারা গেলে, তার মরদেহ নিজ বাড়িতে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।’
আমিনাবাদ প্রবাসী কল্যাণ সমিতির প্রধান উপদেষ্টা ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ কে এম আবদুস সালাম বলেন, ‘এই আমিনাবাদের মানুষ কেউ জেলার বাইরে, কেউ দেশের বাইরে থাকে। এলাকায় থেকেও সারা বছর ব্যস্ত মানুষগুলো তাদের আত্মীয়দের দেখা পায় না। পারে না কুশল বিনিময় করতে। ঈদুল আজহায় সবাই গ্রামে আসে। আরও সহজে দেখা-সাক্ষাতের জন্য বছরের একটি দিনে আমরা ঈদ পুনর্মিলনী, কৃতী ছাত্রছাত্রীর সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি। ওই দিন এখানে দেশের প্রখ্যাত গুণী মানুষেরাও আসেন। এ দিনটিতে পুরো আমিনাবাদবাসী একত্র হয়। সুখ-দুঃখের আলাপ করে। আনন্দ করে। আনন্দ বিলায় জনে জনে। গত পাঁচ বছরে এটি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে আমিনাবাদবাসী এক দিনের জন্য হলেও এখানে হাজির হয়।’
১৯ নভেম্বর আমরা যখন আমিনাবাদ হাইস্কুল মাঠে পৌঁছালাম, তখন বিকেল। এর আগে ঝোড়ো বৃষ্টি হয়ে গেছে। দলে দলে মানুষ মাঠের দিকে এগোচ্ছে। মা-বাবা-সন্তান-সন্ততি যাচ্ছে—যেমন করে মেলায় যায়। বৃষ্টিতে মাঠের ভেতর পানি। ওই পানি ড্রেন কেটে বের করা হলো। বৃষ্টি, তবু মাঠের চারদিকে সারি সারি মুড়ি, মুড়কি, মিষ্টি, খেলনা, পান ও চায়ের দোকান বসেছে। স্কুলের বিশাল মাঠজুড়ে শামিয়ানা টানানো হয়েছে। উঁচু মঞ্চ। সেখানে দেশের বিখ্যাত মানুষের ভিড়। একপাশে স্কুলের বারান্দায় দলে দলে মানুষের রক্তের গ্রুপিং চলছে। এঁরা সবাই আমিনাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র। তাঁরা নিজ উদ্যোগে বিনা অর্থে গত দুই বছর এই দিনে ইউনিয়নের মানুষের রক্তের গ্রুপিং করছেন। ‘ভার্সিটি সার্কেল আমিনাবাদ’ নামের এ সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুকিব বিন আনাস বলেন, ‘গত বছর ৩২০ জন এবং এ বছর প্রায় ৪০০ লোকের রক্তের গ্রুপিং করেছি। যারা রক্তের গ্রুপিং করছে, তাদের নাম-ঠিকানা আমাদের কাছে থাকে। এ ইউনিয়নের যাদের রক্ত দরকার, তাদের ওরাই রক্ত দেয়।’
এ বছর আমিনাবাদের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা জানাতে উপস্থিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোশারেফ হোসেন। তাঁরা আমিনাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে হাজার হাজার মানুষের ঢল দেখে মুগ্ধ। বক্তারা বললেন, এমন ঈদ পুনর্মিলনীতে কৃতী ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের সংবর্ধনা পাওয়া অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের আরও উৎসাহিত করবে। প্রত্যেকটি শিশুই হবে মুসা ইব্রাহীম। তারা এ দেশের অনগ্রসরতা দূর করবে, যেভাবে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। একদিন বাংলাদেশকে সত্যি সোনার বাংলায় রূপান্তর করবে।
এ বছর আমিনাবাদ দক্ষিণ শিবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া মো. রায়হান বলল, ‘আমার ফুফাতো ভাই দুই বছর আগে এ রকম পুরস্কার পাওয়ার পর আমারও আকাঙ্ক্ষা জাগে পুরস্কার পাওয়ার। সত্যিই আজ আমার সে আশা পূর্ণ হয়েছে। ভবিষ্যতে আমি আরও পুরস্কাব পাব এবং এ আমিনাবাদের সব ছাত্র যেন একদিন কৃতী ছাত্র হয়, আমি সে প্রার্থনাও করছি।’
মানুষে-মানুষে এই মিলন দেখে মন ভরে যায়।

No comments

Powered by Blogger.