জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন-আমাদের শান্তিরক্ষীরা লাইবেরিয়ানদের পাশে by মোঃ লুৎফর রহমান

এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফ গিয়ে দিনব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধপত্র বিতরণ করে থাকেন। শুধু বর্তমান কন্টিনজেন্ট ব্যানমেড-৭ কর্তৃক এ হাসপাতাল ও বাইরে স্থাপিত মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে এক বছরে ১০ হাজারের অধিক স্থানীয় রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়


বাংলাদেশ মিশন অ্যাসেসমেন্ট টিমের সদস্য হিসেবে ইউনাইটেড নেশনস মিশনস ইন লাইবেরিয়ায় (ইউএনএমআইএল) কর্মরত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে যে বিষয়টি আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে তা হলো, এ দেশের জনসাধারণের কাছে আমাদের চিকিৎসক ও ওষুধের ব্যাপক সুনাম ও প্রশংসা। ইউএনএমআইএলের অধীনে সর্বপ্রথম যে ক'টি কন্টিনজেন্ট লাইবেরিয়ায় পদার্পণ করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ মেডিকেল কন্টিনজেন্ট, ব্যানমেড। সেটি ২০০৪ সালের কথা। মনরোভিয়া থেকে সড়কপথে এলে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সেন্ট্রাল এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতেই রাস্তার বাম পাশে এর অবস্থান। বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রায় ৬০ জন জনবল নিয়ে গঠিত এ কন্টিনজেন্ট পরিচালনা করছে ইউএনএমআইএলের 'লেভেল-২' হাসপাতাল নামে একটি সুসজ্জিত চিকিৎসাকেন্দ্র।
শুরু থেকেই এ হাসপাতালের দরজা সব সময়ই লাইবেরিয়ার গবির ও দুস্থ জনগণের জন্য খোলা থাকে। স্থানীয় রোগীদের জন্য এ হাসপাতালে ব্যাপক হারে চিকিৎসাসেবার জন্য ফ্রি ফ্রাইডে ক্লিনিক নামে একটি নতুন কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি শুক্রবার এ হাসপাতালের বহির্বিভাগ স্থানীয়দের জন্য উন্মুক্ত থাকে। লাইবেরিয়ার যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণে দূরবর্তী অনেক রোগীর পক্ষে এ হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই এসব রোগীর জন্য ব্যানমেডের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতি মাসেই দিনব্যাপী মেডিকেল আউটরিচ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক দূরবর্তী কোনো এলাকায় এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফ গিয়ে দিনব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধপত্র বিতরণ করে থাকেন। হাসপাতালের দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু বর্তমান কন্টিনজেন্ট ব্যানমেড-৭ কর্তৃক এ হাসপাতাল ও বাইরে স্থাপিত মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে গত এক বছরে ১০ হাজারের অধিক স্থানীয় রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া ও ওষুধপত্র বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জন্য এটি একটি বিরাট অর্জন। ব্যানমেড-৭-এ চিকিৎসা নেওয়া স্থানীয় এক ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তর দেন, বাংলাদেশি ডক্টরস আর গুড, দ্য মেডিসিনস আর স্ট্রং।
ব্যানমেড-৭ শুধু তাদের কার্যক্রম চিকিৎসাসেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। স্থানীয় যুবসমাজকে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ-লাইবেরিয়া ইয়ুথ সেন্টারে (বিএলওয়াইসি) আট সপ্তাহব্যাপী একটি 'ফার্স্ট এইড অ্যান্ড মেডিকেয়ার কোর্স' পরিচালনা করে। ওই প্রশিক্ষণ কোর্সে ২২ জন ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়। এসব শিক্ষার্থীকে মূলত 'ট্রেইন দ্য ট্রেইনার্স' পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা নিজেরাও পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
এ ছাড়া এ কন্টিনজেন্ট কর্তৃক ধর্ষণ প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক দুই সপ্তাহব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্সেরও আয়োজন করা হয়। ব্যানমেড-৭ কর্তৃক স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালসহ অনেক ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সহায়তাও দেওয়া হয়েছে।
ইউএনএমআইএল ম্যান্ডেটে মানবিক কার্যক্রমের যে বিষয়টির ওপর দৃষ্টিপাত করার কথা বলা হয়েছে, তারই ভিত্তিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী স্থানীয় জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যানমেড-৭ ও তাদের পরিচালিত লেভেল-২ হাসপাতালটি আজ সত্যিই লাইবেরিয়ার জনগণের কাছে আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি শুধু মানবিক সাহায্যেরই হাত বাড়ায়নি, বর্তমান ইউএনএমআইএল সিআইএমআইসি (সিভিল-মিলিটারি কো-অর্ডিনেশন) ফোকাস_ 'ক্যাপাসিটি বিল্ডিং'-এর ক্ষেত্রেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এভাবে তারা লাইবেরিয়ার জনগণের হৃদয়-মনকে জয়ের পাশাপাশি সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশটির দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী স্থানীয় জনগণের কল্যাণে কাজ করা বাংলাদেশি সেনাসদস্যদের জন্য নতুন কিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় নিয়োজিত সেনাক্যাম্পগুলো নিয়মিত স্থানীয় গরিব ও দুস্থ জনসাধারণকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্র দিয়ে থাকে, যা পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি স্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা লাইবেরিয়ায় সবসময় গরিব ও দুস্থ জনতার পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। সাত বছরেরও অধিক সময় হলো আমাদের শান্তিরক্ষীদের কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতা তাদের স্থানীয় জনগণের খুব কাছের মানুষে পরিণত করেছে। আর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কটি জরুরি।

মেজর মোঃ লুৎফর রহমান পিএসসি : লাইবেরিয়ার বাঙ্গা থেকে
 

No comments

Powered by Blogger.